1. i@shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র
  2. info@www.shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র :
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৪:২৬ অপরাহ্ন

ট্রেন – টি এম মনোয়ার হোসেন

  • প্রকাশিত: শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৬৮ বার পড়া হয়েছে

ট্রেন

টিএম মনোয়ার হোসেন

নীলসাগর এক্সপ্রেস ধরবে বলেই সাহেদা বানু খুব দ্রুত পা চালায় সৈয়দপুর স্টেশনের দিকে। রাত তখন ৮টা বাজে। অমাবশ্যা চলছে, তাই আকাশে চাঁদ ওঠনি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথ চলছে ঠিকই গাটা ভয়ে শিউরে উঠছে বারবার, একেবারে কাটা দেয়ার মত ব্যাপার। ভূতরূপী মানুষের ভয়তো আছেই, ভূত-পেত্নীর ভয়ও কম নেই। রাস্তার পাশের গাছগুলোতে নানা ভূতের আনাগোনা লেগেই আছে, পথচারীর ঠিকই বুঝতে পারে। বাবার বাড়ি থেকে শশুড় বাড়ি আসার সময় অনেকবারই ভয়ংকর ভূতের কবলে পড়তে হয়েছিল সাহেদা বাণুকেও।

শ্বশুর বাড়ি সৈয়দপুর থেকে ১০-১২ কিলো দূরে ঘুংটির বাজার নামক কোনো এক নিভৃত পল্লীতে। আজ থেকে প্রায় ৫-৭ মাস আগে বিয়ে হয়ে এসেছিল নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থেকে। এক প্রকার ভালবেসেই বিয়ে করেছিল শরিফুলকে। নওগাঁ এর এক ধানের চাতালে অর্থাৎ রাইস মিল; যেখানে ধান সিদ্ধ করে, শুকিয়ে ওখানেই চাল করে এমন জায়গায় কাজ করতে সৈয়দপুর থেকে এসেছিল শরিফুল ইসলাম। তাকে দেখতে যুবক মনে হলেও যুবক নয়, ৩৬-৩৭ বছর পার হয়ে ৩৮ বছরে পা ফেলেছে সে। এ বয়সী কাউকে যুবক বলা যায়। একই মালিকের চাতালে কাজ নেয় সাহেদা বানুও। বয়লারে আগুন দেয় সাহেদা, শরিফুল তারই আশেপাশে কাজ করে। সারাদিন একটানা পাশাপাশি থেকে ৮-৯ ঘণ্টা কাজ করতে হয় দু’জনকে। কদিন আর মুখ বুঝে থাকে, আগ বাড়িয়ে একদিন সাহেদার জীবনের গল্প শুনতে চায় শরিফুল। কী আর করে, আঁচলে মুখটা ঢেকে তার এতিম জীবনের গল্প শোনায়। বলতে বলতে এক সময় চোখ ভিজে ওঠে, আঁচলটা টেনে নিয়ে চোখের পানি মুছে।

শরিফুলও কিন্তু তার গল্পে ব্যথিত হয়। আফসোস করে, মুখে আ… উ… শব্দ করে, কেঁদেও ফেলে গল্পের শেষে।

শরিফুলকে চোখ মুছতে দেখে সাহেদা বানু, তার এমন উদারতা আর কিছুটা দুর্বলতা দেখে সাহেদার মনে ভালবাসা এসে বাসা বাঁধে। মনে মনে ভাবে, যারা অন্যের দুঃখের কাহিনী শুনে ঠিক থাকতে পারে না, কেঁদে ফেলে; তারা নিশ্চয়ই ভাল মানুষদের। একজন না হয়ে পারে না। যতই দিন যায় শরিফুলকে সাহেদা বানুর ভালই লাগে, শরিফুলও সাহেদাকে ভালবেসে ফেলে। সুযোগ পেলে তার কঠিন কাজগুলোও শরিফুল নিজে হাতে করে দেয়, ফলে কিছুটা স্বস্থি পায় সাহেদা।

আগেই বলে নেয়া ভাল, সাহেদা কিন্তু স্বামী পরিত্যাক্তা একজন। – মহিলা। স্বামীর ঘর-সংসার বেশিদিন করতে পারেনি, তালাক – দিয়েছিল কী এক ছোটোখাট দোষে। উপায় না পেয়ে রাইস মিলে এসে কাজ নেয়। কাজ করতেই তো শরিফুল এর সাথে  জানাশুনা হয়। বেশিদিন প্রেম প্রেম খেলতে হয়নি, সাহেদার চাপে একদিন রাতের অন্ধকারে ওর হাত ধরে চাতালের কাজ ফেলে উধাও হয়। কোনো এক মসজিদের মোয়াজ্জিনের কাছে  কবুল পড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তারা। ক’দিন বাহিরেই – কাটায় শরিফুল তার নতুন বউ সাহেদা বানুকে নিয়ে।

এক-দেড় মাস পরে সায়েদ তার বাড়ি সৈয়দপুরে নিয়ে আসে। এসেই তো অবাক সাহেদা বানু। তার ঘরে আরও দু’টা বিয়ে করা বউ আছে। নিজ চোখে দেখে আর গাঁয়ের মহিলাদের কানাকানি শুনে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম, এক সময় দাঁতে দাঁত লেগে মাটিতে টলে পরে সাহেদা। তিন-চার  ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। অবশেষে জ্ঞান ফেরে তার। ডানে তাকায়, পাড়ার অনেক নারী-পুরুষ সমবেত হয়েছে, তাকে দেখছে আর – আফসোস করছে সবাই। তার অনিশ্চয়তার জীবন নিয়ে বলাবলি করা শুরু করেছে। সাহেদা চোখ দু’টো বন্ধ করে ভাবে আর বিরবির করে বলে, আমার কপালটাই হয়তো এ রকম, নইলে দুই বউ ওয়ালা শরিফুলের প্রেমে হাবুডুবু খাই কী ভাবে।

কষ্টে-শিষ্টে কয়েক মাস মুখবুজে স্বামীর সংসারেই জোঁকের মত লেগে থাকে, যদি একটু সুখ পায়। না, খাপ খাওয়াতে পারেনি নিজেকে। বিনা কারণেই সাহেদা বানুকে ধরে যখন তখন শরিফুল আর দুই সতীন অমানবিক নির্যাতন করে, মুখে পিঠে খুনতির ছ্যাকা দেয়। সতীনদের এমন জ্বালা সইতে না পেরে গাঁয়ের মাতব্বরদের আশ্রয় নেয়, হাত-পা ধরে, একটা বিহিত করতে বলে।

নিজের দেশে ফিরে যেতে চায় সাহেদা বানু।

আজ তারই ফয়সালা হয়, গাঁয়ের মানুষের উপস্থিতিতে সাহেদা বানু শরিফুল এর হাত থেকে, তার অত্যাচার থেকে মুক্তি পায়। ফয়সালা হতে হতে একটু রাতই হয়। গাঁয়ের অনেকেই রাতটা কেটে যেতে বলে সাহেদাকে।

কিন্তু….কে শোনে কার কথা। টাম-টোপলা বেঁধে নওগাঁ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সেই থেকে হাঁটছেই, সাহেদা বানু রাতের অন্ধকার ভেদ করে পা ফেলে।

রাস্তায় কোনো জনমানব নেই, নেই কোনো আশেপাশে বাড়ি ঘরও। এছাড়াও রাস্তার দু’ধার আখ ক্ষেতে ভরা, চিকন, সরু রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে সৈয়দপুর রেল স্টেশনের দিকে।

চলতে চলতে সাহেদা বানু শিয়ালের ডাক শুনতে পায়, মাঝেমাঝে কি যেনো অপরিচিত প্রাণীর ডাকও কানে ভেসে আসে। বুঝতে পারেনা এ ডাক। কানপাতে কিন্তু কী করার, চলতে তো হবেই। আর বোধ হয় বেশি দূর নয় সৈয়দপর রেল স্টেশন, কয়েক কদম ফেললেই পৌঁছা যাবে, এ ভেবে দ্রুত পা চালায় সে। আর অতীতের কথা, ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাঁদতে থাকে হুহু করে। আজকের ছাড়াছাড়ির কথাও ক্ষণেক্ষণে মনে ভেসে উঠছে, অমনি ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে বারংবার। কিন্তু… কিছুক্ষণ পরে ঠিকই সে সংবরণ করে নেয়। আবার কান পাতে, দূর থেকে কেমন যেনো মানুষ মরার সময় কষ্ট পেয়ে যেমন গোঙ্গায় তেমন আওয়াজ শুনতে পায়। থমকে দাঁড়ায় ডানে বায়ে তাকায়। কি আর দেখবে, চারপাশ তো অন্ধকারে ঢাকা। সাহেদা বানু থামতেই গোঙ্গানীও থেমে যায়, ভয় এসে আঁকড়ে ধরে। তারপরেও ভয়কে পরওয়া না করে চোখ মুছতে মুছতে সামনের দিকে এগোতে থাকে।

মুখ তুলে সামনের দিকে তাকাতেই আখের ক্ষেতের উপর দিয়ে স্টেশনের বৈদ্যুতিক আলো চোখে পড়ে। পথ হয়তো আর তেমন বাকি নেই, সামনের ক্ষেতটা পেরোলেই স্টেশন। কিন্তু না, আরও বেশ কয়েক কিলো পথ পড়ে আছে। একটু এগুতেই একটা শিয়াল সাহেদা বানুর সামন দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়, অমনি থমকে দাঁড়ায় সাহেদা, আল্লাহর নাম ডাকে বার কয়েক। কি আর করার, চলতে তো হবেই, না কী? এখানে তো আর বসার কোনো সুযোগ নেই। কান খাড়া করতেই পায়ের শব্দ শুনতে পায়, কে যেনো পিছে পিছে সাহেদাকে অনুসরণ করছে। শব্দটা তেমন কাছে না, দূরেই মনে হয়। লোক যে তা কিন্তু মালুম হয় না: একবার কাশাকাশিও করে না। সাহেদা দাঁড়াবে, না চলতে থাকবে তা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আগ-পাছ ভেবেই

চলতে থাকে অনবরত। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে পোটলাটা বগল চাপা দিয়ে একটু দৌড়ানের মত করে হাঁটতে থাকে। রাস্তায় তেমন কোনো বিপদ-আপদ হয়নি, একসময় স্টেশনে এসে পৌছে সাহেদা। এসে দেখে, স্টেশনে কোনো গাড়ি নেই, ফাঁকা স্টেশন, লোকজনও তেমন চোখে পড়ে না। সাহেদা টিকিট কাউন্টারে যায়, দেখে স্টেশন মাষ্টার নেই, সিমেন্টের আসনগুলোতে দু’একটা কুকুর বসে মাথা মোড়ন দিয়ে ঘুমোচ্ছে। দূরের একটা সিটে উসকো খুসকো জটা চুল ওয়ালা এক পাগল বিরবির করে কি যেনো বকবক করছে। আর… মাঝেমাঝে বিকট – শব্দ করে কাকে যেনো গালি দিয়ে ওঠে, বিশ্রী ধরনের গালি।  সাহেদা শোনা মাত্রই নিজের কান দুটো নিজেই চেপে ধরে। ভাল করে কক্ষে নজর ফেলে, মাষ্টার পশ্চিম মুখ হয়ে এশার নামায – আদায় করছে। সাহেদা না ডেকে খোলা দরজার পাশে পোটলাটা = নিচে দিয়ে বসে পড়ে।

প্লাটফর্ম এর দিকে তাকায় আর ভাবে, সাড়ে আটটার সময় তো – সান্তাহার গামী নীলসাগর এক্সপ্রেসটি দাঁড়িয়ে থাকার কথা। তাহলে কী সময় হয়নি, নাকি চলে গেছে তাও তো ঠাহর করতে -পারছি না। জিজ্ঞেস যে করবো তেমন কোনো লোকও নেই। স্টেশনে।

। সাহেদা বানু কিছুক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ায়, এক পা, • দু’পা করে সামনে এগোতে থাকে, এসে ১নং প্লাটফর্ম এর কিনার ঘেষে দাঁড়ায়। দূরে দৃষ্টি ফেলতেই দেখে, পরিত্যাক্ত একটি ন মালবাহী ট্রেনের বগিতে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। বাতির আলো যখন জোরালো হয় তখনই একটি নারীর মুখ স্পষ্ট হয়ে – ওঠে। প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ, একটা পাগলি মাটির হাঁড়িতে কী যেনো। সিদ্ধ করছে। সাহেদা বানু সামনের দিকে পা ফেলবে অমনি – পিছন থেকে সিমেন্টের আসনে শুয়ে থাকা পাগলটি গলার স্বর মোটা করে বলে ওঠে, ওই… সাহেদা, সামনে আর এগোস না, ও কিন্তু মানুষ না, অশরীরী ছায়া, খপ করে ধরে ফেলবে, তোর রক্ত চুষে খাবে। কি বিশ্বাস হয় না আমার কথা…? যা, যায়াই দেখ, আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে কীনা।

সাহেদা বানু থমকে দাঁড়ায়, পাগলীটার কাছে যেতে সাহস আর হয় না। কিন্তু নিজেকে একা একা লাগছে, এতবড় একটা স্টেশন অথচ একটা জন মানব নেই, যেয়ে মানুষ তো দূরের কথা। কিছুক্ষণ নিজের মনের সাথে বোঝে, কোনো সমাধান খুঁজে না পেয়ে চার, পাঁচটা প্লাটফর্ম পার হয়, দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী গাড়িটায় খোলা একটা বগির কাছে এসে নাঁড়ায়, পাগলি থেকে ২-৩ হাত দূরে।

খিকখিক করে হাসে পাগলি, রান্নার দিকে মন দিয়ে মাথা নিচু করেই। বলে, কী রে সাহেদা বানু, কী চাস এখানে? মরতে এসেছিস, যুক্তি? কী দেখছস অমন করে, আমি তোর পরিচিত কেউ না মানুষও সই তুই এখান থেকে চলে যা। আমার রক্তের নেশা উঠলে কিন্তু তুই বাঁচতে পারবি না, আমার হাত থেকে, চলে যা।

শাহেদা বানু চমকে উঠে গলার আওয়াজ শুনে। তার কথায় ভিষণ ভয় পেয়ে যায়, কোনো কথাই গলা দিয়ে বের হতে চায় না. এখান থেকে কেটে পড়লে বাঁচে। তারপরেও তোতলাতে তোতলাতে বলে, তুমি এখানে বসে বসে কি করছো, পাতিলে কী রান্না করছ? দূর থেকে তোমায় আমার প্রথম সতীনের মত দেখাচ্ছিল, এসে ভুল ভাঙ্গলো, তা নয়, তুমি তো অন্য কেউ। হাসতে হাসতে পাগলিটা মুখ ঘুরায় সাহেদা বানুর দিকে, পাগলির দিকে দেখেই তো জ্ঞান হারানো মত হয়ে টলমল করছে, কখন যে প্লাটফর্ম এর উপর পড়ে যায়। বাপরে বাপ… কত বড় বড় দাঁত, মুখটা কদাকার, চামড়াটা মৃত ব্যাক্তির চামড়ার মত, দাঁতে লাল টসটসে রক্ত লেগে আছে, জিহ্বাটা একেবারে অস্বাভাবিক লম্বা। লকলক করছে আর নিচের দিকে ঝুলে আছে, লালা পড়ছে টপটপ কর। ঘৃণায় সাহেদা বানুর বমি আসতে গিয়ে থেমে আছে, যখন তখন বমি করে বসতে পারে। কর্কশ গলায় বলছে, কোথায় যাবি এত রাতে, তোর ট্রেন তো চলে গেছে এক ঘণ্টা আগেই। স্টেশনে গিয়ে বসে থাক, একটা বিশেষ ট্রেন আসবে রাত ১২টা এক মিমিটে, আমরাও যাবো ঐ বিশেষ ট্রেনে চড়ে। তোর সান্তাহারে যাওয়া খুব জরুরি, তাই না?

ঠিক আছে যেতে পারলে যাস, আমরা সবাই থাকবো ট্রনে, ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, আমরা ভূত-পেত্নী হতে পারি কিন্তু…. ভাল আর অসহায়দের কোনো ক্ষতি করি না; বরং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই।

বলেই পাগলী অন্য মনস্ক হয়, পাতিলের ঢাকনা খোলে, একটা শিশু বাচ্চার হাতের কবজী পাতিল থেকে তুলে নিয়ে কড়মড় করে চিবুতে থাকে। সাহেদা বানুকে দেখিয়ে দেখিয়ে আরও জোরেশোরে চাবায় গো গো শব্দ করে আর খায়। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে সাহেদাকে বল, কি রে… কি দেখছস, খাবি না কী? না না, তোরা তো মানুষ, এসব খেতে পারবি না। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন খাই। আগে খাইনি আমি যখন মানুষ ছিলাম। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে অর্থ্যাৎ ১৫৫৮ কিংবা ৫৯, ৬০ সালে। অনেক ইতিহাস, শুনবি? ভয় পাবি না তো? শোন, জেনে রাখা প্রয়োজন।

রক্তে ভেজা ডান হাতটা লম্বা জিহ্বা দিয়ে চাটতে চাটতে মুখটা উপরে তোলে, সাহেদাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, আমার বাস কুসুম্বা গ্রামে, নওগাঁ জেলার মান্দা থানায়। কুসুম্বা দিঘীর পশ্চিম পাড়ে পাথরের তৈরি ধূসর বর্ণের মসজিদ আছে, তুই হয়তো দেখে থাকবি, এ দেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে যে মসজিদের ছবি আছে তার উত্তর পাশে একটা শিমুল গাছে থাকি আমরা। প্রায় সাড়ে চারশত বছর থেকেই আমি আর বাবা শিমুল গাছটায় বাস করে আসছি। এ দিঘী বাবাসহ আরও দশগ্রামের মানুষ মিলে সেই সময় তৈরি করেছিল। মসজিদটা অবশ্য সবরখান বা সোলায়মান নামে একজন মিস্ত্রী নির্মাণ করেছিল, তখন ছিল – গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ এর সময়। মসজিদের পাশে একটা – কূপও আছে, সেটাও বাবাই খুঁড়েছে, অথচ এ কূপেই আমাদের  বাপ-বেটির মৃত্যু হয়।

সাহেদা বানু ভয়-ডর উপেক্ষা করে জানতে চায়, কী করেছিলে যে নিজের খোঁড়া কূপে বাপ-বেটিকে জীবন দিতে হলো? ন সে অনেক কথা, তোরা যদি কখনো কুসুম্বা মসজিদটা দেখতে যাস, ভাল করে খেয়াল করবি, দেখবি, মসজিদের ভিতরে উত্তর- – পশ্চিম কোণের স্তম্ভের উপর একটি উঁচু আসন আছে। অনেকেই না ধারণা করে এখন, বাস্তবেই ঐ আসনে বসে তৎকালীন কাজী বা বিচারকরা এলাকার বিবিন্ন সমস্যার বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। একদিনের এক বিচারে আমাদেরও শাস্তি হয়। একজন অসহায় মেয়ের জীবন বাঁচাতে আমরা বাপ-বেটি সাক্ষী হয়ে এসেছিলাম, আমরা হেরে যাই প্রতাপশালী ধনবানদের কাছে, আমাদের মৃত্যুদন্ড হয়। সেই থেকে আমরা অশরীরী ছায়া বা আত্মা হয়ে কূপের পাশের শিমুল গাছেই রয়ে গেছি আজও। সাহেদা বানু পাগলীর আরও কাছে যায়, গাটা স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিন্তু শরীর নেই শুধু হাড় বা কংকাল হাতে ঠেকে। পাগলীকে কাঁদতে দেখে সাহেদা বানু, তারও কষ্টে বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। জীবনে এই প্রথম ভূতদের কান্না করতে। দেখে সাহেদা। তবে অশ্রুজল নয়, তাজা রক্ত বেরোয় পাগলীর দু’চোখ বেয়ে। চোখ মুছতে মুছতে পাগলী বলে, স্টেশনে যে বুড়ো পাগলকে শুয়ে থাকতে দেখেছিস, সে আমার বাবা, আর বেঞ্চে বসে থাকা কুকুরগুলো আমাদের সাথেই থাকে, ওরাও প্রাণী ভূত। সাহেদার ভয় আরও বাড়তে থাকে, বুকটা ভয়ে কুঁকড়ে আসে, কোথায় এসে পড়েছে তাই ভাবছে ক্ষণে ক্ষণে আর মুখটা তুলে আল্লার নাম স্মরণ করছে বারেবারে। চারপাশে ভূত আর পেত্নানীতে ভরা, ট্রেনটা চলে গেছে। কী করবে সাহেদা তাই ভাবছে স্টেশনের দিকে ফিরে আসতে আসতে। দেখে থাকবি, এ দেশের পাঁচ টাকার কাগজের নোটে যে মসজিদের ছবি আছে তার উত্তর পাশে একটা শিমুল গাছে থাকি আমরা।

– প্রায় সাড়ে চারশত বছর থেকেই আমি আর বাবা শিমুল গাছটায় – বাস করে আসছি। এ দিঘী বাবাসহ আরও দশগ্রামের মানুষ মিলে সেই সময় তৈরি করেছিল। মসজিদটা অবশ্য সবরখান বা – সোলায়মান নামে একজন মিস্ত্রী নির্মাণ করেছিল, তখন ছিল  গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ এর সময়। মসজিদের পাশে একটা – কূপও আছে, সেটাও বাবাই খুঁড়েছে, অথচ এ কূপেই আমাদের বাপ-বেটির মৃত্যু হয়।

সাহেদা বানু ভয়-ডর উপেক্ষা করে জানতে চায়, কী করেছিলে যে নিজের খোঁড়া কূপে বাপ-বেটিকে জীবন দিতে হলো? সে অনেক কথা, তোরা যদি কখনো কুসুম্বা মসজিদটা দেখতে যাস, ভাল করে খেয়াল করবি, দেখবি, মসজিদের ভিতরে উত্তর- পশ্চিম কোণের স্তম্ভের উপর একটি উঁচু আসন আছে। অনেকেই  ধারণা করে এখন, বাস্তবেই ঐ আসনে বসে তৎকালীন কাজী বা বিচারকরা এলাকার বিবিন্ন সমস্যার বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। একদিনের এক বিচারে আমাদেরও শাস্তি হয়। একজন অসহায় মেয়ের জীবন বাঁচাতে আমরা বাপ-বেটি সাক্ষী হয়ে এসেছিলাম, আমরা হেরে যাই প্রতাপশালী ধনবানদের কাছে, আমাদের মৃত্যুদন্ড হয়। সেই থেকে আমরা অশরীরী ছায়া বা আত্মা হয়ে কূপের পাশের শিমুল গাছেই রয়ে গেছি আজও। সাহেদা বানু পাগলীর আরও কাছে যায়, গাটা স্পর্শ করার চেষ্টা করে কিন্তু শরীর নেই শুধু হাড় বা কংকাল হাতে ঠেকে। পাগলীকে কাঁদতে দেখে সাহেদা বানু, তারও কষ্টে বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। জীবনে এই প্রথম ভূতদের কান্না করতে দেখে সাহেদা। তবে অশ্রুজল নয়, তাজা রক্ত বেরোয় পাগলীর দু চোখ বেয়ে। চোখ মুছতে মুছতে পাগলী বলে, স্টেশনে যে বুড়ো পাগলকে শুয়ে থাকতে দেখেছিস, সে আমার বাবা, আর বেঞ্চে বসে থাকা কুকুরগুলো আমাদের সাথেই থাকে, ওরাও প্রাণী ভূত।

সাহেদার ভয় আরও বাড়তে থাকে, বুকটা ভয়ে কুঁকড়ে আসে, কোথায় এসে পড়েছে তাই ভাবছে ক্ষণে ক্ষণে আর মুখটা তুলে আল্লার নাম স্মরণ করছে বারেবারে।

চারপাশে ভূত আর পেত্নানীতে ভরা, ট্রেনটা চলে গেছে। কী করবে সাহেদা ভাই ভাবছে স্টেশনের দিকে ফিরে আসতে আসতে

পাগলীর কাছ থেকে স্টেশনে ফিরে এসে একটা ছাঁকা বেজে গিয়ে জয়ে যায় গুটিগুটি হয়ে বসে, চুপথে যাওয়া বেগুনের মত

কোন দিকে তাকানোর সাহস পায় না সাহেদ্য, মাথা নিচু করে বসে আছে মাটির পুতুলের মত হয়ে, নড়াচড়া নেই কোনো।

ছাড়া পাগল মাথার উপয়ে ঢেকে দেয়া আপড়টা সরায়, মুখটা বের করে অবিকল মানুষের মত শব্দ করে সাহেলাকে বলে, কি যে ফিয়ে আসতে পেরেছিস, পাগলী প্রণী ভূতটা তোর ক্ষতি করেনি? যে তো কাউকে ছাড়তে চায় না, রাতের অন্ধকারে থাকে

শায় তারই রক্ত চুষে খায়। তোকে ছেড়ে দিলো কেনো? তুই নিশ্চয় ভাল মানুষের দলে পড়েছিল, সে শুধু খারাপ মানুষের ক্ষতিই করে থাকে, আমার মেয়ে বলে কথা, সাড়ে চারশত বন্ধয়ে কোনোদিন আরো ক্ষতি করেনি, তবে খারাপ মানুষের বারটা বোরেই জোড়েছে

সাহেশ্য কাঁদতে থাকে, বুজিয়ে ফুফিয়ে আঁদছে আর চোখ মুড়ায় বৃদ্ধ ভূতটি তাকে আশ্বস্থ করে বলে, আয়ে কাঁদছিস কেনো,

আমরা যোয় ক্ষতি করতে আসিনি, আময়াও ট্রেনের অপেক্ষায় আছি, বিশেষ ট্রেনটা এলেই চলে যাবো। এখান থেকে, তুই যদি যেতে রান তো কাউন্টারে গিয়ে একটা টিকেট কেটে দে। না গেলে তোর বিগন আরও বাড়বে, এখানে স্বতগুলো নেশাখোর মানুষ এসে ভিড় করছে, আমরা আছি বলেই ওরা আসার সাহস পায়নি। তোকে একা পেলে ওরা আর মানুষ থাকবে না, অমানুষে পরিণত হবে, শিয়াল, শকুনের মত ছিড়ে ছিড়ে খাবে। তারচেয়ে বরং ভূতের ট্রেনেই যাওয়া ভাল, তাই না? সাহেল বৃদ্ধ ভূতকে বাধা বলে সম্বাধন করায় কেমন যেনো চোখে মুখে হাসির ঢেউ খেলে যায়, কুকুরগুলোকে হাতের ইশারায় কি যেনো বসে, বসা মাত্রই সাহেদাকে চারটা কুকুর এসে ঘিরে বসে পাড়। এরা ভূত হলেও এদের আচরণ স্বাভাবিক কুকুরের মতই, বেশ প্রস্তু ভক্ত।

একটা কুকুর মানুষের মত করে বাংলায় বলে, আমরা থাকতে তোমার জোনো ক্ষতি হবে না, তোমার বাবার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবো, এ হুকুমই ফরলো আমাদের প্রভু। তার হুকুম অমান্য করা

মোটটই সম্ভব না। তুমি বসে থাকে। আমরা পাহাড়া দেই। (কমন যেনো ট্রেন আসার ঘণ্টা বেজে ওঠে, টিকিট কাউন্টার থেকে সায়েদাকে ডাকে, কাছে যেতেই হাতে একটা টিভিট ধরিয়ে দেয়। লেখা তেমন বোঝা যায় না, ঝাপসা। শুধু সান্তাহার আসন নং দেখে একটু ঘাবড়ে যায়, লেখ্য আছে, বিটি ৭৬৬ ভূ। খড়িতেও ১২.০০ বাজে। ঠিক ১২:০১ বাজতে না বাজতেই শাঁ কয়ে ট্রেন এসে এক নং প্লাটফর্ম এ দাঁড়ায়, কোনো তাড়াহুড়া নেই, আ নিয়ে জেনো প্রতিযোগিতা নেই, নেই কোনো ধড়াসারিও।সাহেনারও উঠতে বেশি বেগ পেতে হয়নি, অনায়াসেই ট্রেনে ওঠে। পিছে পিছে ওঠে চারটা কুকুর, এরপর হয়। ওঠার প্রায় আর কেউ নেই, ট্রেনটি নড়েচড়ে ওঠে। কোনো হুইসেল হাজেনি ফ্লাগ ম্যান নেই শৌশনে, অমনি গাড়ি চলা শুরু করে, না বা করে ছুট চলে অন্ধকার জেন করে। সাহেদা বানু ট্রেনে উঠেই তো অবাক। একটা লোক নেই ট্রেনে, প্রতিটি দিয়ে শুধু কংরাল আয় কংকাল, পা গেলার জায়গা নেই। মনে হয় না একটা একটা ট্রেন, মনে হয় পুরান কোনো রাজবাড়ির আংসস্তূপ। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত প্রাণীর গলার আওয়াজ, চিৎকার চেচামেচি আর অসহায় মানুষের আর্ত চিৎকার। কোথা থেকে যে আসছে তা জানে না সাহেলা বাবু। ভূত্বরে ট্রেনটির মাত্র চারটা বগি আর স্টেশনে পড়ে থাকা মালবাহী গাড়ির বগিটি যে বণিটিতে বসে পাগলী রান্না করছিল। ভেসে আসছে তারা হফের গন্ধ, নাক চিপে ধরে কোনো মতে একটা লাশের পাশে আঁটোসাটো হয়ে বসে থাকে। বাতি জ্বলছে না ট্রেনটিতে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে অসহায় হয়ে বসে আছে সাহেনা, করার কিছুই নেই তার। ফাকে চিৎকার করে জানাবে, সে সুযোগ আর রোখায়া কোনদিক থেকে কোনদিকে যাচেরা তা ঠাহর করতে পারছে না সে। গাড়িতে ওঠার পর আর বৃদ্ধকে চোখে পড়েনি, কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেলো, জানে না।

ট্রেন ট্রেনের মতই চলছে, বোঝার কোনো উপায় নেই এটা একটা কুরুতে টেন। বী সব অদ্ভুত চিৎকার, চেঁচামেচি কানে ভেসে আসছে। অধিরত। একের পর এক সত্যিকারের স্টেশনগুলো অতিক্রম করছে, প্রতিটি স্টেশনে দাঁড়ায়ও, দাঁড়ানোর সাথে সাথে ফরক মিনিংগ্রাই দশ-পনেরটি করে মৃত, কংকালসার লাশ ফেলে দেয় জানালা নিয়ে, তারা আবার স্টেশনে পড়েই তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ায়, সোজা হাটা ধরে। স্টেশনের বাহিরে হারিয়ে যায় চোখের পলকে। সাহেদা বানু অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে ভূতের তামাশা দেখে।

মনে মনে বলে, এরা তো আমার ক্ষতি করছে না। এদের এমন তামাশ্য আমি আমার জীবনে কোনোদিন দেখিনি। যাক, দেখার সৌভাগ্য হলো, আগে অবশ্য ভূত-পেত্নীতে বিশ্বাস তেমন ছিল না। ওরে বাবা, এরা এমন খেলা খেলছে, খারাপ লাগছে না, ভালই তো। কিন্তু হঠাৎ যদি আমার উপর হামলে পড়ে, তখন? বলতে বলতেই বৃদ্ধ ভূত সাহেদা বানুর সামনে এসে হাজির। গলার আওয়াজা কেমন যেনো আগের মত নেই, ভয়ংকর লাগছে। সাহেদ্যকে আশ্বস্ত করে বলে, মা, ভয় পেয়ছিস? বলেছি কো, তোর কোনো ভয় নেই, কেউ তোর ক্ষতি করতে পারবে না, এ ভূতের দলটা আমার হয়েই কাজ করে, আমার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করার সাহস পাব না। আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো, একটা অপারেশন এ গেছিলাম, তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আর থাকতে পারিনি। যেহেতু আমাকে বাবা ডেকেছিস, আমি ভূত হলেও কোনো না কোনে সময় তো মানুষ ছিলাম, সেই ভালবাসা আজও বুকের মধ্যে আছে রে মা। আমি পাশে বসে আছি, তুই ঘুমা, ক্লান্ত লাগছে তোকে। দেখতে দেখতে ট্রেনটি ভবানীপুর, ফুলবাড়ি, বিরামপুর, ভাঙ্গাপাড়া স্টেশনগুলো পার হয়ে এসেছে, এখন এসে থেমেছে হিলি স্টেশনে। ইন্ডিয়া থেকে মালামাল পাচারকারীরা যেই ট্রেনে উঠতে যাবে অমনি তাদের টুটি ধরে ভূতেরা ছুঁড়ে মারছে স্টেশন থেকে ১০০ হাত দূরে, ধপাস ধপাস করে মাটিতে পরছে আর ওমা গো, ও বাবা গো বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়ে পালাচ্ছে। কারো হাত ভাঙ্গছে, কারো পা ভাঙ্গছে, কারো বা মাখা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

সাহেদা মনে মনে খুশিই হয়েছে, এ ভাবে যদি সারা বাংলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, অন্যায়কারীকে সঙ্গে সঙ্গ শাস্তি প্রদান করা হত, তাহলে দেশটা আরও উন্নত ও বিশ্বের দরবারে ভাল অবস্থানে অবস্থান নিত।

একজন পাচারকারীও এ ট্রেনে উঠতে পারেনি, উঠেছে মাত্র দু জন তারা ভূতের দলের, দু’টা জীবন্ত মানুষকে হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় কাঁধে করে ট্রেনে তোলে। কোথায় নিয়ে গেলো তা আর ঠাহর করতে পারেনি সাহেদা। ট্রেনটি বাঁকি দিয়ে আবার চলতে থাকে, তবে সাধারণ ট্রেনের মত শব্দ করে নয়, কেমন একটা ভিন্ন শব্দ সৃষ্টি করে ছুটতে থাকে। পার হয় বাগজানা, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, জামালগঞ্জ, আক্কেলপুর।

জাফরপুর হয়ে তিলকপুরে গৌঁছে। রাত তখন ৩:০০ বাজে। দূরে এক গীর্জা থেকে ঘণ্টার ধানি ভেসে আসে। পাগলী বৃদ্ধ বাবা কাছে এসে পাশের সিটে বসে পড়ে। চোখ দু’টো আগের মত রক্তাক্ত না, কেমন একটা মায়াবী ভাব ফুটে উঠছে, সাহদার ভয় আর নেই, উবে গেছে। পাগলী ভূতটা তার বৃদ্ধ বাবাকে শান্ত-শিষ্ট ভাবে বলছে, বাবা শয়তানটাকে ধরতে পেরেছি, তুমি নিজের হাতে শান্তি দিও, আমি ওর কোনো ক্ষতি করিনি।

বৃদ্ধ ভূতটা একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলে, ঐ শয়তানকে মারবোতো সান্তাহার স্টেশনে গিয়ে।

সাহেদা কিছুই বুঝতে পারে না, কার কথা বলছে ওরা, কাকে মারবে। গাটা আবার কাটা দিয়ে ওঠে, একটা ভয়ংকর দৃশ্য দু’চোখে ভাসতে থাকে।

কয়েকটা লাশ ডিঙ্গিয়ে টয়লেটে যায়, পাশের টয়লেট থেকে একটা পরিচিত ব্যাক্তির চিৎকার শুনতে পায়, কান পাতে সাহদা, তার দ্বিতীয় স্বামী শরিফুল এর কন্ঠস্বর। অবাক হয়ে যায়। এখানে শরিফুল এলো কী ভাবে?

মাথার মধ্যে নানা ভাবনা ঘোরপাক খায়, টলতে টলতে এসে একটা কংকালের উপর হুড়মুড় করে পড়ে যায়, ও.. মা… বলে চিলভার বার ওঠে, অমনিই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছাভিয়্যানক্র্যাম স্টেশন হয়ে সান্তাহারে এসে পৌঁছে ট্রেনটি। সাহেদ্দা বানুকে কোলে করে নামায় পাগলী ভূত। নিজের কোনো ক্ষতি হয়নি চোখ মেলে বুঝতে পারে সাহেদা। ধীরে ধীরে চারপাশে তাকায়, পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রাণী ভূত চারটি, বৃদ্ধ, তার হাতের থাবায় শরিফুল, আর পাগলী ধরে আছে ঘুংটির বাজার এর মাতব্বর যে সাহেদার ঘর ভাঙ্গে, মিথ্যা একটা বিচার করে সাহেদাকে শরিফুলের কাছ থেকে দূরে সরে দেয় নিজে বিয়ে করবে বলে।

সাহেদা তো হতবাক। এরা জানলো কি ভাবে?

পাগলী হুংকার দিয়ে বলে, ঐ হারাম জাদা, একটা অসহায় মেয়ের সর্বনাশ করতে চেয়ে বিচার বসিয়েছিলি, তাই না? তোর হাড়গোড় চিবিয়ে খাবো অন্যায়ভাবে বিচারের রায় দেয়ার দায়ে। আমরা বাপ-বেটি মানুষের রূপ নিয়ে তোদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে স্টেশনের দিকে আসছিলাম, সাহেনা বানু ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল মিটিংয়ের বাহিরে বসে। কান্নার শব্দ বাবার কানে পৌঁছে, আমিও শুনতে পাই। আমরা আর সামনে না এগিয়ে তোনের গাঁয়ের সালিশে যোগ নেই। অসহায় মেয়ের বিচারের বায়ের অপেক্ষা করতে থাকি। আমি তোদের এক গায়ের মেয়ের রূপ ধরে বলেওছিলাম সাহেদার কোনো দোষ নেই, সব দোষ মাতব্বরের। ক্ষেপে গিয়ে ঐ মহিলার চুলে মুঠি ধরে সবার সামনে দু’গালে চড় কষিয়ে দিয়েছিলি, মনে পড়ে? ঐ মানুষরূপী শয়তান, খেয়াল কর। আমার গালেই চড়গুলো পড়েছিল, ইচ্ছে করলে গাঁয়ের সব মানুষের সামনে তোর মাথা চিবিয়ে খেতে পারতাম, কিন্তু কিচ্ছু করিনি, শরিফুলের দুই সতীনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে এই নরপিশাচ, মতকার আগুন ধরিয়ে দেয় সাহেদার কপালে। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার বিচার দেখি। আর কোনো শব্দ না করে ওখান থেকে কেটে পড়ি।

মাতকার বুঝতে পারে, আর রেহাই নেই। হাত জোড় করে সাহেদাকে মা ডেকে বলে, আমাকে মাফ করে দে মা। শরিফুলের হাতে সাহদাকে তুলে দিয়ে বৃদ্ধ ভুত বলে, যদি সাহেদা মায়ের কিছু হয়, বুঝতে তো পারছিস, এই কুকুর রূপী ভূতের পেটে যাবি। আমরা আশে পাশেই থাকবো। আর মাতব্বরের কোনো মাফ নেই, এ বেঁচে থাকলে সমাজের আরও অনেক নিষ্পাপ মেয়ের সংসার ভাঙ্গবে। তায়েকে আমরা একে ছিড়ে ছিড়ে খাবো, রক্ত চুষে খেয়ে শুধু কংকালটা ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেলে দেবো, তোর নিস্তার নেই।

বলেই টুটিটা ধরে মাতাব্বরকে ট্রেনে তোলে। সাহেদা আর শরিফুলকে স্টেশন থেকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায় ট্রেনটি।

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
Theme Customized By BreakingNews