জলছাপ – মনিরুজ্জামান বাদল
চৌধুরীর চালচলন দেখতে বীর পুরুষের মত। আসলে সে খুব ভীতু প্রকৃতির মানুষ। স্থানীয় কোনো নেতা কর্মী অফিসে আসিলে ঘনঘন চাপা মারেন, যেমন ওমুক মন্ত্রী আমার শ্যালক, তমুক আইজি আমার খালাতো ভাই, প্রধানমন্ত্রীর পিএস আমার ভাগ্নী জামাই, গাজীপুর সদরের এসপি আমার মেয়ের জামাই। অনেকে তাঁর গল্প শুনে দুর্বল শেয়ালের মত লেজ গুটিয়ে চলে যায়। আবার কেউকেউ এসব কথা অবান্তর ভেবে মনে মনে চৌধুরীকে গালি দেয়। আসলে সাহসী মানে সবসময় গর্জে উঠা নয়। অনেক সময় সাহসী তারাই যারা দিন শেষে শান্ত গলায় বলে আমি আবার কালকে চেষ্টা করবো। প্রতিটা মানুষের জীবনে কষ্ট আছে শুধুতা প্রকাশ করার পদ্ধতি ভিন্ন। নির্বোধরা প্রকাশ করে চোখের পানি দিয়ে আর বুদ্ধিমানরা প্রকাশ করে মৃদু হাসি দিয়ে। চৌধুরী পৃথিবীর সব মানুষকে বোকা ভাবে। তাই যেখানে সেখানে ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে গুলি ছুড়ে। নুরী তিন দিন অনুপস্থিত থেকে আজ সকাল সাতটায় অফিসে আসছে। চৌধুরীও গতকাল রাতেই অফিসে আসছে।
রাকিব সাহেব মনে মনে চান এসব নাটকীয়তার একটা পরিসমাপ্তি ঘটার দরকার। তাই চৌধুরীকে সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগিয়ে বললেন: স্যার! নূরী অফিসে আসছে?
জ্বী স্যার!
– সব অফিসারকে আমার রুমে বসতে বলো!
– ওকে স্যার।
– সবাই সারি সারি চেয়ার পেতে চৌধুরীর টেবিলের সামনে বসলো। চৌধুরী কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিএম ও ইডি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললো-
জিএম সাহেব এবং ইডি সাহেব আজ আপনাদেরকে আমি যে উদ্দেশ্যে এখানে ডেকেছি সেটা হলো গত তিনদিন আগে নুরী যে কাজটি করলো এটা কি ঠিক করেছে?
: জ্বী না স্যার। (জিএম উত্তর দিলেন)।
: আমার ইচ্ছা ছিলো আমি আরও কয়েকটি দিন ঢাকায় অফিস করবো কিন্তু শুধু নুরীর জন্য আমার দ্রুত চলে আসতে হলো। আমি কি
কোম্পানি পরিচালনা করবো নাকি নুরীকে নিয়ে বসে থাকবো? কেউ কোনো কথা বলছে না, সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো?
চৌধুরীর মুখে এমন কথা শুনে নুরী অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরাতে লাগলো। একসময় তাঁর বুকের জমানো কষ্টগুলো তীব্রভাবে বেড়ে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো নুরী।
চৌধুরী একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে বলেই যাচ্ছে। চৌধুরী খুব শান্ত গলায় নুরীর কাছে জানতে চাইলো- : নুরী, তুমি কি আমাকে ফাঁসাতে আসছো নাকি চাকুরি করতে আসছো? : চাকুরি করতে আসছি!
: তাহলে তুমি ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলে কেন?
: আমার বুকের কষ্ট দেখার কেউ নেই এই কোম্পানিতে তাই খেয়েছি। : এই কোম্পানিতে কোন অফিসারটা আছে তোমাকে আদর করে না?
সবাই তোমাকে ভালোবাসে।
: সবাই আমাকে আদর করে, কিন্তু। আমি সবার ভালোবাসা চাই না। ওপরওয়ালার পরে আমার বুকে আমি যাকে স্থান দিয়েছি তার ভালোবাসা আমি না পেলে আমি এখানে একটি মুহুর্তের জন্যও থাকবনা।
চৌধুরী সব জেনেও না জানার ভান করে নিজেকে খুব সৎ চরিত্রবান দেখিয়ে বলছে- আমি তোমার কোন সাইটটা অপূর্ণ রাখছি? তুমি বললা স্যার আমি নামাজ পড়বো অফিসে আমাকে একটা জায়নামাজ কিনে দিন, দিলাম, আবার বললা আমাকে একটা বোরকা বানিয়ে দিন সেটাও পেলে, আবার বললা স্যার আমার বাসায় একা একা ভালো লাগে না, একটা টিভির প্রয়োজন, সেটাও কিনে দিলাম, আমি এই কোম্পানির এমডি এটা তোমার বুঝতে হবে। তুমি যদি মনে করো আমাকে চাকরের মত ব্যবহার করবে সেটা আমার পক্ষে সম্ভবনা। তুমি যখন আমাকে খেতে ডাকবে সাথে সাথে আমার যেতে হবে খেতে হবে এটাতো আমার পক্ষে সম্ভবনা। নুরীর কাছে আজ মনে হচ্ছে চৌধুরী খুব অকৃতজ্ঞ মানুষ। যাঁর চরিত্র বিছানায় মোমের মত নরম তাঁর কথায় আজ ভরা মজলিসে এতটা শক্ত কি করে হলো? নানা প্রশ্ন নুরীকে জর্জরিত করে তুললো। আলোচনা করতে করতে একসময় বিকেল চারটায় শেষ হলো কোন ফাইনাল সিদ্ধান্ত কেউ নিতে সাহস পায়নি। সবাই জানে চৌধুরী নুরীকে ছাড়া একদিন থাকতে পারবেনা। এর আগে বহু কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে রিক্রুটিং অফিসার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন কিন্তু কোনোমতেই একমাসের বেশি টিকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিটি মেয়েই চৌধুরীকে পাকা চরিত্রহীন উপাধি দিয়ে বেতন ফেলে চলে গেছে। একমাত্র নুরীই টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। অফিসে কোনো মেয়ে না থাকলে সবসময়ই দোষটা সব অফিসারদের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া চৌধুরীর নীতিগত অভ্যাস হয়ে গেছে। নুরী একসময় ঢাকায় একটা আবাসিক হোটেলে কন্ট্রাকে দেহ ব্যবসায়ীর কাজ করতো। সেটা দিয়ে তাঁর সংসার চালাতে কষ্ট হতো। ন্যায্য পাওনা কখনোই নুরীকে দেওয়া হতো না। সেখান থেকে তাঁকে তুলে এনে চৌধুরীর সামনে হাজির করেছেন সাবেক কোনো একজন মার্কেটিং অফিসার। চৌধুরী যেমন মনেমনে খুঁজছিলেন ঠিক তেমনই পেয়েছেন নুরীকে। সমস্যা শুধু একটাই ভোগের মাত্রাটি বেড়ে গিয়ে একটা চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে চৌধুরী। তীব্র একটা ভয় চৌধুরীর মনে সবসময়ই কাজ করে কখন জানি এলাকার সব লোককে বলে দেয়। এই জন্য অনেক সময় নুবীর অমানবিক আচরণগুলোও নুরী অবুঝ মেয়ে, এতিম মেয়ে, মায়ের আদরের দুষ্ট মেয়ে বলে চালিয়ে নেয়। কিন্তু এখন নুরী চৌধুরীর কাছে কাঁটাযুক্ত ফল গলায় আঁটকে থাকার মত হয়েছে, এদিক ওদিক কোনো দিকেই যায়না। না পারতেছে অফিস থেকে বের করে দিতে না পারতেছে অফিসে রাখতে। সবাই যাঁর যাঁর মত দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে চলে গেলো।