1. i@shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র
  2. info@www.shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র :
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:১২ অপরাহ্ন

একটা হলুদ রিকশার ইতিকথা-মনিরুজ্জামান বাদল

  • প্রকাশিত: রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০২৪
  • ৮৬০ বার পড়া হয়েছে

একটা হলুদ রিকশার ইতিকথা

মনিরুজ্জামান বাদল।

ছোটোবেলায় খুব অভাবের সংসারে ছিলো আমাদের বেড়ে ওঠা। তিনবেলা পেটভরে খেতে পারতাম না। ভাত থাকলে তরকারি থাকতো না, তরকারি থাকলে ভাত থাকতো না। ব্যকারণের ভাষায় যাকে বলা চলে নূন আনতে পান্তা ফুরোয়। খুব কম বয়সেই দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। যে বয়সের ছেলেদের হাতে থাকে ব্যাট -বল, কক,ব্যাটমিন্টন,সেই বয়সে আমার হাতে থাকতো সকালে নীড়ানি, বিকেলে কোদাল, হাতের তালুতে অসংখ্য ঠোঁসা, একজন কৃষাণীর দিন মজুরি ছিল তিরিশ থেকে চল্লিশ টাকা। অথচ জমি চাষাবাদ করার মত কৃষাণী নেওয়ার মত পুঁজি ছিলো না। সকাল-সন্ধ্যা বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলতেন দুই কেজি চাল আর লবণের টাকা জোগার করতে। বাবা বাজার নিয়ে আসবে আমরা দুই ভাই অনাহারী পাখির বাচ্চার মত বারবার মায়ের কাছে বলতাম বাবা কখন আসবে, কখন আসবে?  অসংখ্য রাত বাবার বাজারের আশায় আশায় থেকে নির্ঘুম অনাহারী কাটিয়ে দিয়েছি।  বাবার একটি ভাঙ্গা হলুদ রিক্সা ছিলো। বাবার হলুদ রঙ খুব পছন্দের ছিল। আমি হলুদ রঙের মানে বুঝতাম না। হলুদ কার্ড মানে হুশিয়ার সংকেত। আমাদের জীবনটাও নাকি হুশিয়ারী সংকেত হিসেবে ভাবা হয়। এই সুখ-স্বাচ্ছন্দ, আরাম আয়েশ নাকি খুব ক্ষনিকের। জীবনের পরতে পরতে বহুবার  আমরা ঘুমে থাকতেই বাবা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যেতো। কোনও দিন বাজারের টাকা আয় হতো, আবার কোনদিন বাবা খালি হাতে ফেরত আসতো। গ্রাম থেকে উপজেলা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের পথ। ওই সময় রাস্তায় ইট বিছানো থাকতো। কার্পেটিং বলতে কিছু ছিলো না। সম্ভবত নব্বই দশকের দিকে হবে।  সেখানে একজন মানুষ পায়ে চালিত রিকশায় যেতো মাত্র দশ টাকায়। সময় লাগতো একঘন্টার থেকে দেড়ঘন্টা। সত্যি কথা বলতে, ওই সময় রিকশায় ওঠার মতো তেমন লোকজন পাওয়া যেতো না। ঘরে ঘরে দুর্ভিক্ষের ছোপ ছোপ ছাপ। সকলের চোখে মুখে থাকতো ভালো থাকার দুঃস্বপ্ন। অনেকেরই জমি আছে কিন্তু ভালো ফলন পাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিলো না। ফসল হতো শুধু, আখ,পাট,গম, প্যারা,কাউন,আর খেসারির ডাল।  আমি প্রতিদিন দেখতাম বাবা সকাল আটটার দিকে রিকশার প্রতিটা চাকায় নাড়িকেলের তেল দিতেন। চাকায় তেল দিলে নাকি চালাতে কষ্ট কম হয়। ওই রিকশা নিয়ে বারবার নানা রকম প্রশ্ন উঁকি দিতো আমার মনে। আমি সম্ভবত ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ি। ছাত্র হিসেবে এক থেকে দশের ভেতরে ছিলাম। এই নিয়ে বাবা খুব খুশি থাকতেন আমার উপর। বাংলা রিডিং খুব দ্রুত পড়তে পারতাম। জটিল জটিল শব্দ উচ্চারণ করা আমার জন্য কোন সমস্যা ছিলনা। চিঠির প্রচলন ছিল প্রবল। প্রতি সপ্তাহে দুই চারটা চিঠি আমাকে পড়িয়ে শুনাতে হতো প্রতিবেশীদের। মা প্রায়শই বলতো, পোলাডারে লেখাপড়া করিয়ে কি লাভ হইবো! আমরা সারাজীবন কষ্ট করে পড়াশোনা করামু, মধ্যে থেকে পরের মেয়ে এসে টেক্কা মারবো। মা কথাগুলো খুব আক্ষেপের স্বরেই বলতেন। আমি ওসব বুঝার চেষ্টাও করতাম না। বাবার হাতের দিকে মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম কখন হাতুড়ি, পাম্পার আনার হুকুম দিবেন। বাবা যতক্ষণ বাড়ি থাকতেন ততক্ষণ আমি বাবার মুখের দিকে বারবার তাকিয়ে থাকতাম। বাবা বুঝতে পারতেন না। বাবা সামান্য বাংলা রিডিং পড়তে পারতেন। মা একেবারেই নিরক্ষর ছিলেন।আমার পুরো নাম মোজাম্মেল হক বাবা সবসময়ই পুরো নাম ধরেই ডাকতেন কিন্তু মা ও দাদীমা আদর করে মোজা বলে ডাকতেন  । বাড়ির কাছেই স্কুল। খালিপায়ে ক্ষেতের আল ধরে একদৌড়ে স্কুলে চলে যেতাম। রাতে বাবা আমাকে হারিকেনের আলোয় পড়া শেখাতো। স্কুলে যা পড়িয়েছে আমার মুখ থেকে তা শুনতে চাইতো। বাংলা বা সমাজবিজ্ঞান  বই বের করে, কোনো একটা অংশ দেখিয়ে দিয়ে জোরে শব্দ করে পড়তে বলতো। আমি থেমে থেমে সেই অংশ বাবাকে পাঠ করে শোনাতাম। আমার পাঠ শুনতে শুনতে একফাঁকে বাবা ঘুমিয়ে যেতো। মা বলতো— ‘হইছে, মোজা , এইবার হারিকেন নিভাই দিয়া ঘুমাই যা; কেরাসিন বেশি নাই।’ বাবার গলায় হাত রেখে আমিও একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখতাম, রিকশার মেরামতের কাজগুলো প্রায়ই বাবাই করতেন। মেকারের কাছে নিতেন না। আমিও কিছু কিছু কাজ বাবার কাছে দেখে দেখে শিখতাম। যেমন, চাকায় হাওয়া দেওয়া, লিক সারানো,গলা টাইট দেওয়া, চেইন ছোট বড় করা,বাল্বটিউব লাগানো,জুতা সেলাই করা  ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়ির মানুষ বলতো,ছ্যাড়া কোন কাম অছাফি নাই। আমি এতে রাগ করতাম না।মোদ্দাকথা পড়াশোনার পাশাপাশি জুতো সেলাই থেকে শুরু করে বই মলাট করা পর্যন্ত খুটিনাটি সব কাজই পারতাম। সংসারে অভাব সবসময় লেগে থাকলে যা হয়। ওই সময় বন পাথারে বাপ- দাদার জমি জমা থাকলেও তেমন কাজে আসতো না। ফসল হতো আখ, পাট, ধানের চাষ খুব কম হতো। চাউল আট টাকা দশ টাকা কেজি, ষাট টাকা হলে এক কেজি গরুর মাংস পাওয়া যায়। ফাহিমা শাড়ী, সিংগাপুরী গেঞ্জি, ভাগলপুরী লুঙ্গি, গোসলের জন্য  ৫৭০ ও কস্কো সাবান  খুব জনপ্রিয় ছিলো। গরীব ধনী সবাই ওগুলোই ব্যবহার করতো। আমার তখন উঠতি বয়স, একটা প্যান্টকে তিনবার বড় করেছি। যখন দেখতাম নিচে আর বাড়ানোর মত সুযোগ নেই তবুও দরদী নয়নে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম ইশ! প্যান্টটা তাহলে এবার  ফেলে দিতেই হবে? বলে আবার ভাঁজ করে রেখে দিতাম আঁখক্ষেত নিরানী কাজ করার জন্য। শীতের রাত বরাবরই লম্বা হয়ে থাকে। রাত্রির প্রথম প্রহরে ঘুম না আসলে আর অতিসহজেই ঘুম আসতে চায় না। সারাদিনের খুটিনাটি নানাকিছু মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করে ভাসতে থাকে। বাবার রিকশার হলুদ রঙের রহস্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে বাবা এককথায় উত্তর দিতেন,বাবা আমরা যখন দুনিয়াতে আসছি তখনই আল্লাহ তায়ালা হলুদ কার্ড গলায় ঝুলিয়ে পাঠিয়েছে। লাল কার্ড দেখালেই ওপারে চলে যেতে হবে।  যে কোন সময় তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। আমি বাবার উত্তর শুনে বিরক্ত হতাম, আর মনে মনে ভাবতাম ধুরু! কার মধ্যে কি!আমি জানতে চাইলাম কি, উত্তর পেলাম কি? নাইনে ওঠার পর আমি সংসারের হাল ধরলাম। এই হাল ধরা মানে সেই হাল ধরা নয়। বাবার সামান্য ফসলি জমিটুকুতে নিজেই চাষবাস শুরু করে দিলাম। বিপত্তি ঘটলো পড়াশোনায়। ক্ষেতে – খামারে সারাদিন কায়িক পরিশ্রম করার পর আর পড়ার টেবিলে মন বসে না। ঘুমের পাথরটা চোখের পাতায় ভর করে বসে। এই নিয়ে বাবা-মা প্রতিদিন বকাঝকা করতো। পাশের বাড়ির শফি মাস্টারের উদাহরণ দিতো। আমি নির্বাক হয়ে হালের গরু দুটির দিকে তাকিয়ে ভাবতাম ইশ! তুই কত সুখীরে! আর আমি সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও রাতে একটু শান্তিমত ঘুমাতে পারি না। বইয়ের পাতা খুলে জীবনের বেহিসাবি গল্পের যোগবিয়োগের ফল নামানোর অপচেষ্টায় মেতে থাকতাম। মা পাশের ঘর থেকে পড়ার শব্দ না শুনে বিরক্ত কন্ঠে বলতেন, — নে মোজা, এখন ঘুমিয়ে পড়।

সকালে ফজরের নামাজ পড়ে বই নিয়ে বসিস।

আমি মায়ের কথায় ঘুমিয়ে পড়তাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানার একপাশে জানালা খুলে দিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসতাম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মাচার নিচে তাকিয়ে দেখতাম একমাত্র সম্বল আলু গুলো নতুন কোষ নিয়ে তরতর করে বেড়ে চলছে। বাবা আলু গুলো রাখছে বাজারে আলুর দাম একটু চড়া হলে বিক্রি করবে, কিন্তু প্রতিদিন শুধু খবর আসে আলুর বাজার খুব নিম্নমানের। কথা ছিল বাবা আলু বিক্রি করে নতুন স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিবেন। প্রতিদিন নিয়ম করে সূর্য উঠে আবার অস্ত যায়, গ্রীষ্মের দাবদাহন পেড়িয়ে বর্ষা,শরৎ,হেমন্ত শীত ও বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে শিমুলের বৃক্ষের ডালে রক্তজবার মত রক্তিম ফুল ফুটে অথচ অভাবের সংসারে দুঃখের কোন পরিবর্তন আসে না। নিত্যদিন যেন দারিদ্র্যের কষাঘাতে হাতুড়িপেটা করে পুরো পরিবারটিকে। শত কষ্টের মধ্যেও বাবা আমার দিকে তাকিয়ে সুখের স্বপ্ন বুনতেন সকাল সন্ধ্যা। পঁচিশ বছর পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মোজাম্মেল এখন নামি-দামি গ্রুপ কোম্পানির ম্যানেজার পোস্টে কর্মরত। ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হয়ে পাঁচ তালা একটা বাড়ির ফ্ল্যাটের মালিক। স্ত্রী আয়েশা ও দুই যুবরাজ পুত্রদের নিয়ে  মোজার সংসারে সুখ নামক পাখিটি ঠিকই ধরা দিয়েছে, কিন্তু বাবা ও মা দু’জনই যোজন যোজন দূরে ওই আকাশের তারাগুলোর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। বারবার মনের অজান্তে জানতে ইচ্ছে করে শ্রদ্ধেয় বাবা-মা কোথায় আছে, কেমন আছে।  জীবনের সকল সুখ যেন কালো ধোঁয়ার মত উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে মোজার। সিগারেটের মাথায় আগুন হঠাৎ নীভে যায়, সেদিকে পুরোপুরি বেখেয়ালি।  রাত্রিও ফর্সা হয়ে নতুন দিনের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে,জানালার পাশে হাসনাহেনা ফুলের গন্ধটাও ভোরের স্নিগ্ধতার সাথে মিশে গিয়ে কাঁচা রোদে ছড়িয়ে যায় ।  কিন্তু পেছন থেকে এখন আগের মত কেউ আর ডেকে বলে না, মোজা কুফিতে তেল নাই, বই থুইয়্যা এহন ঘুমা।

আমি ভাবি একটি কচি পাতার জীবন চেয়েছিলাম

অবিকল মেহেদী পাতার মতো! মনের বেখেয়ালে

মনের গভীরে বেঁধে গেছে বাদামী অসুখ।

প্রেমহীন গল্প, শিহরণ নেই, উল্লাস নেই, ঋতুচক্রে বসন্তের সুবাস ছড়িয়ে দিলেও মায়াময় চোখের উঠোনে নামেনা নতুন কোন রোদের স্নিগ্ধতা।

অস্ফুটে বলা হয়নি কিছুই , সূর্যের নীচে, জোছনায় মাখানো পথপাশে মেঠো ঘাসে, ভোরের শিশিরে, ছিলো মমতায় ভরা মিনতি। সাথে একটা বিকেলের নৈসর্গিক দৃশ্য ছিল। শুধু নেই বাবার অফুরন্ত প্রেম।

ম্রিয়মাণ বসন্তের বিকেলে হলদে পাখির ডাক।

শহরের মোড়ে মোড়ে রাস্তায় কালো কার্পেটের ওপর হলুদ দাগ দেখলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে বাবার হলুদ রিকশার কথা। এস করল্যা গাড়িতে বসে নেহাতই কানে ভেসে আসে বারবার  বাবার রিকশার টুংটাং আওয়াজ।

বিষের মত তেঁতো মনে হয় গাড়ির প্যাৎ—পুৎ শব্দ।

রিকশার বেলের টুংটাং আওয়াজই যেন জীবনের সবচেয়ে বড়  সুমধুর সুর ছিল।

 

রচনাকাল- বিশ,জানুয়ারি,বিশ বাইশ ।

 

 

 

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
Theme Customized By BreakingNews