1. i@shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র
  2. info@www.shahitterkagojbrammaputro.online : সাহিত্যের কাগজ ব্রহ্মপুত্র :
সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৫:৩৩ অপরাহ্ন

জলছাপ  –মনিরুজ্জামান বাদল, পর্ব- এক

  • প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৬৫ বার পড়া হয়েছে

এক

জলছাপ – মনিরুজ্জামান বাদল 

তুই যদি কখনো আমার সামনে পড়িস ——– বাচ্চা!  তোকে আমি জ্যান্ত কবর দিবো! শালা অমানুষের বাচ্চা!   কথাগুলো মনের বেখায়ালেই বিরবির করে রাকিব সাহেব বলছিলেন। রাকিব আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে চৌধুরীর একটি প্রাইভেট সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে একাউন্স সেকশনের ম্যানাজারের দ্বায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। রাকিব সাহেব খুব নম্র ভদ্র প্রকৃতির সদা মিষ্টভাষী মানুষ। তিনি সর্বদা চেষ্টা করেন সততা নিষ্ঠার সাথে ক্যাশ খতিয়ান ল্যাজার মেইনটেইন করতে। কিন্তু তাঁকে প্রতিনিয়ত একটা দুশ্চিন্তা তাড়া করে। এই বুঝি এখনি চৌধুরী ফোন করে গালিগালাজ শুরু করে। বাংলাদেশে প্রায় চার হাজারেরও বেশি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারমধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই গ্রামের অল্প শিক্ষিত সহজ সরল নির্বোধ ছেলেগুলোকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিছু অসাধু লোকের মাধ্যমে তাদেরকে গ্রাম থেকে তুলে আনা হয়। তারপর তাদের কাছে একটা মোটা অংকের টাকা নিয়ে অধিক বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অত্র প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগ দেওয়ার পর থেকে শুরু হয় তাঁদের উপর একধরনের মানষিক নির্যাতন ও ভয় ভীতি দেখানো যাতে খুব সহজেই পালাতে বাধ্য হয়। যেমন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা বেতন ধরে কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়া শীল্প প্রতিষ্ঠান গুলোতে অন্ধকার অলিতে গলিতে দিন রাত ডিউটি করানো । ডিউটি করতে করতে প্রতিটি ছেলে অত্র প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সে স্বইচ্ছায় বেতন ফেলে পালাতে চায় ঠিক সেই মুহুর্তেই তাঁকে অফিসে ডেকে মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাকরি করতে বাধ্য করানো হয়। একজন নিরাপত্তা প্রহরী পাঁচ হাজার টাকা জামানত দিয়ে তিনমাস পর যখন ম্যাসের টাকা ইউনিফরমের টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ও সার্ভিস চার্জের টাকা কর্তণ করে তাঁর হাতে তিনশ টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয় তখন তাঁর হুহু করে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কার কাছে বিচার দিবে? স্থানীয় নেতা-কর্মীর কাছে গেলে তাঁরা উল্টো চরথাপর দিয়ে আবার ডিউটি করতে পাঠিয়ে দেয়। কেউ টাকার অভাবে সারারাত ডিউটি করে দিনে রিক্সা চালিয়ে বৌ বাচ্চা সামাল দেন আবার কেউ মাথায় করে মাটি নেওয়ার কাজ করে নিজের খরচের টাকা জোগাড় করেন । কিন্তু এভাবে একজন গ্রাম থেকে উঠে আসা নির্বোধ ছেলে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে আর কতদিনই বা জীবন নায়ের বৈঠা চালাতে পারে? কয়দিনই বা না ঘুমিয়ে দিনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে রাত জাগতে পারে? ক্লান্তি মানুষ মাত্রই থাকতেই পারে! কর্তব্যরত থাকা নিরাপত্তা প্রহরী রাতে নিজের অজান্তে ঘুম আসতেই পারে! মাঝেমধ্যে দেখা যায় বেতন প্রদান করার সময় চলে আসলে রাত তিনটা চারটার দিকে লাঠি নিয়ে চৌধুরী প্রতিটা পোস্টে ঘুরেঘুরে যাঁকে যে অবস্থায় পেয়েছেন ঘুমের মধ্যে পিটিয়েছেন। যাকগে চাকরিটা যখন হয়ে যায় তখন ওই শ্রমিক একবুক আশায় বৌ বাচ্চা নিয়ে একটা ভাড়াটে বাসায় উঠে এ যেন আরেকটি বিপদ নিজের কাঁধে স্বইচ্ছায় তুলে নিলেন। কিন্তু তিন মাস চার মাস ছয় মাস অতিক্রম হওয়ার পরও যখন ন্যায্য বেতন না পায় তখন তাঁর সুখময় ঘরটা জাহান্নামের একটা অংশে পরিনত হয়। শত শত দম্পতি ভেঙে্গ টুকরো টুকরো হয়ে গেছে রাকিব সাহেবের জীবদ্দশায়! কি করবে? নিজেই তো জ্বলছে একটা নীরব দহনের তপ্ত লেলিহানে! রাকিব সাহেবের কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো ২০১০ সালের দিকে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল। প্রতিদিন ঔষধের ফার্মেসীগুলোতে বসে এ পত্রিকা ও পত্রিকা হাতরিয়ে হাতরিয়ে একটা চাকরি খোঁজেন। অবশেষে দৈনিক পত্রিকার এককোণে আকর্ষণীয় বেতনের কর্মসংস্থান খালি দেখে ফোন করে বুকভরা আশা নিয়ে জামাকাপড় গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। গ্রামের কিছু নিন্দুক আগেপিছে সবসময়ই একটা সমালোচনা করে বলেন  রাকিবের কপালে কখনো ভালো চাকরি জোটবে না। আর সংসারও পাতা হবে না। এসব কথা শোনে বাবা মাও ভেঙ্গে পড়েন ছেলেকে নিয়ে। অবশেষে নিজেকে অভিশাপ মুক্ত করতেই বাড়ির বাহির হয়ে চলে আসে। পরদিন চাকরিটা হয়ে গেলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে নানা আলোচনা সমালোচনা শুনে চাকরিটা করতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু গ্রামের মুখপোড়া কিছু লোকের কথা ভেবেই অবশেষে মনস্থির করেন না এসব ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই, যেভাবেই হোক চাকরিটা তাঁর করতেই হবে। নিজেকে অভিশাপ মুক্ত না করে আর বাড়ি ফিরবে না। বাহিরে ফাগুনের দাবদাহ থাকলেও মনের মধ্যে একটা ব্যথা এক টুকরো মেঘের মত জমে দলা পাকিয়ে আছে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই বাইক নিয়ে প্রতিটা পোস্টে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়, এখানে গার্ডে গার্ডে মারামারি করেছে, ওখানে সুপারভাইজার নেই, সেখানে রাতে ক্যাবল চুরি হয়েছে, অমুক ম্যাসে বাজারের টাকা নেই, তমুক ম্যাসে চৌকি নেই, ফ্যান নেই,এগুলো একটার পর একটা সমাধান দিতে দিতে বেলা বেজে যায় দশটার মত, আবার শুরু একাউন্ট পে চেকগুলো ব্যাংকে জমা দেওয়ার পালা, সেখানে চলে যায় আরো এক থেকে দেড় ঘন্টা। এরপর সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার একসাথে খেয়ে শুরু হয় আরেক অধ্যায় অমুকের কাছে বকেয়া টাকা তুলতে হবে তমুকের সাথে মিটিং করতে হবে, নতুন চুক্তিবদ্ধ করতে হবে এর পাশাপাশি আরও কিছু কাজ থাকে যেটা নিকটস্থ থানায় সবসময়ই  প্রতিদিন থানার ওসিকে তৈল দেওয়া যেন একটা নিত্য দিনের রুটিন। গত কয়েকদিন আগে রাকিব সাহেবের অনুপস্থিতিতে অত্র প্রতিষ্ঠানের রিসিভশনিস্ট কর্মচারী নূরী সিকিউরিটি ইনচার্জ হিসেবে কুমিল্লা থেকে আসা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আসলামকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আসলাম একজন মামলা খাওয়া দাগী আসামী। তিনি কিছুদিন পরপর চাকরি পরিবর্তন করেন আর নিজের খালাসী বইয়ের নিজের নাম ঠিকানা পরিবর্তন করে নতুন করে চাকরিতে যোগদান করেন। হয়তো রাকিব সাহেব অফিসে উপস্থিত থাকলে জাল কাগজপত্র ধরতে পারতেন। কিন্তু নূরী ধরতে পারেনি। মৌখিক কিছু ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়োগ দিয়ে পোস্টে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আসলাম খুব ঝানু লোক। কিভাবে ফ্যাক্টরীতে ডাকাতি করতে হয় সেই কৌশল তাঁর মুখস্থ। সে প্রতিদিন রাতে সমস্ত নিরাপত্তা প্রহরীকে ফ্রীতে চা খাওয়ান আর গল্প করেন আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে আসার সময় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পেয়েছি এই টাকাই আমার খাওয়ার মানুষ নেই। তোমরা সবাই আমার ছেলের মত। তোমরাইতো আমারটা খাবে। আমার কথা হলো সবাই ঠিকঠাক সুন্দরমত রাতে ডিউটি করো, কেউ ঘুমাইও না। এভাবে দিন গড়াতে থাকে আর আসলাম ধীরে ধীরে সবার প্রিয় একজন ইনচার্জ হয়ে ওঠেন। এই কথা কেউ কখনো রাকিব সাহেবকে জানায়নি। টানা বিশ দিন ডিউটি করার পর আসলাম চায়ের সাথে সবাইকে চেতনানাশক ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ফ্যাক্টোরীর ভিতরে কাভার্টভ্যান প্রবেশ করিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার ফেব্রিকস রোল নিয়ে পলাতক। রাত প্রায় তিনটার কাছাকাছি। হঠাৎ রাকিব সাহেবের ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করেই দেখে চায়না ডিরেক্টর কল দিয়েছে —চায়না ডিরেক্টর মিঃ পং। পং বাংলাদেশে থেকে মোটামুটি সব কথাই বাংলায় বলতে পারে, মাঝেমধ্যে দুই একটা ইংরেজিও বলে। রাকিব সাহেবও ওদের কথা শুনতে শুনতে বাংলা ইংরেজি মিলে কথা বলতে শিখেছে।

–হ্যালো!

— ইয়াহ!

— এই রাকিব তু-মি তারাতাড়ি আপিসে আ-সা!

— বস, প্রোবলেম?

— তু-মি  কি কাস করা এ্যা!

— বস! তুমি প্রোবলেম বলা?

— তোমার সিকিউটি সব গুংকরা ( ঘুমিয়ে)!

রাকিব সাহেব বুঝতে একবিন্দুও বাকি রইলো না। নিশ্চিত কোনও সমস্যা হয়েছে, ভেবেই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে ফ্যাক্টরীতে গিয়ে দেখে বারোজন সিকিউরিটি সব অজ্ঞান হয়ে আছে। আর কোনও কথা না বাড়িয়ে দ্রুত সবগুলোকে নিকটস্থ উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিলেন। পরের দিন সকালে পুলিশের বহর সাংবাদিক চলে আসলো। পত্রিকায় সমস্ত ঘটনা ছাপানো হলো। রাকিব সাহেবকেউ সন্দেহমূলক আসামী করা হলো। রাকিব একটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। কেন এমন হলো। মিঃ পং পুলিশ অফিসারকে বলে রাকিব নির্দোষ তাঁর নাম কাটা হোক। রাকিব সাহেবের নাম কেটে দেওয়া হলো। রাকিব সাহেব সব সিকিউরিটির সঠিক চিকিৎসা করিয়ে আবার ফ্যাক্টোরীতে নিয়ে আসলেন। সেখানে প্রায় সিকিউরিটি অল্প শিক্ষিত। কোনওমতে নাম ঠিকানা লিখতে পারে। তাদেরকে একজন একজন করে থানার তদন্তের ওসি জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। কেউ সঠিক কোনও তথ্য দিতে পারলো না। অবশেষে একজনের একটু ব্যতিক্রম কথা শুনে উপরস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে বুঝানোর জন্য দুইজনকে গ্রেফতার দেখানো হলো। রাকিব সাহেবের সামনে দিয়ে হাত কড়া পড়িয়ে কোর্টে পাঠানো হলো। রাকিব সাহেবের জীবনে নেমে এলো আরেক ট্রাজেডি। আসামী আসলামের সকল কাগজপত্র ফাইল করে মাঠে নেমে পড়লেন আসামীর নাম ঠিকানা সনাক্ত করার জন্য। সকল কাগজপত্র ঘেটে অবশেষে যা পেলেন সেটা হলো ভুয়া কাগজ। ওর নামের সাথে কাগজের কোনও মিল নেই। মানুষ এতটা জালিয়াতি করতে পারে ভাবতেই কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে রাকিব সাহেবের। কোথায় যাবে কি করবে ভাবতেই পারছে না। বান্ডিলে বান্ডিলে টাকা ছিটাচ্ছেন প্রশাসনের কর্মকর্তার টেবিলে, কিন্তু কোনও ভাবেই আসামীর সঠিক ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। সাতদিন পর পুলিশের একটা টিম আসামীর গ্রামের ঠিকানায় চলে গেলো। সেখানে কয়েকটা গ্রাম ঘুরে আসামীর আসল পরিচয় মিললো কিন্তু আসামী পরিবারের কারও সাথে তাঁর কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁর নামে এমন ঘটনার মামলা একাধিক বার হয়েছে জানায় আসামীর পরিবারের সদস্যরা। যুদ্ধে হেরে যাওয়া পরাজিত সৈনিকের মত সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লেজ গুটিয়ে চলে আসলো। পরেরদিন থেকে ঢাকার অলিতে গলিতে চিরণী অভিযান চালালো সকল পুলিশ গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু ফলাফল শুন্য। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না শুধু অজস্র টাকা চলে যাচ্ছে আইনি সহায়তা নিতে যেয়ে। রাকিব সাহেব চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে পুলিশ পারে না এমন কোনও কাজ নেই! আসলে এখানে পুলিশের কোনও ব্যর্থতা কাজ করছে নাকি আসলে আসামীকে গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

 

 

 

 

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
Theme Customized By BreakingNews