চৌধুরীর বয়স এখন ষাটের উপরে। তাঁর অবয়বে সবসময়ই “একটা রাগান্বিত ভাব ফোটেই থাকে। আসলে এটা ওর স্বভাব নয়, একটা পলিসি। কোম্পানি পরিচালনা করতেই নাকি তিনি এমন মুড নিয়ে থাকেন। সবার সাথে হাসি নিয়ে কথা বললে নাকি ওর ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাই প্রতিনিয়ত সকল কর্মকর্তার সাথে কর্কশ মেজাজে কথা বলেন। স্বভাবতই রাগী মানুষের চরিত্র খুব সুন্দর হয়ে থাকেন, অথচ তিনি তাঁর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাবের। গত তিন বছর যাবত ওই প্রতিষ্ঠানে নুরী রিসিপশনের কাজে নিয়োজিত আছেন। নুরী চারিত্রিক দিক থেকে খুব নোংরা স্বভাবের। টাকা পেলে নিজের দেহ যৌবন বিলিয়ে দিতে কিঞ্চিৎ (কৃপণতা বোধ) করেনা। যৌবনের শুরু থেকেই প্রবাস জীবন কাটিয়ে জীবনে কিছুই করতে পারেনি। সর্বস্ব হারিয়ে এসেছে সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতে। তাঁর কাজ শুধু এতটাই বললে চলে চৌধুরীর সেবা দান করা। এই সেবা দান ওই সেবা দান নয় যে সেবা চৌধুরীর খাওয়ানো ঘর গোছানো, এখানে বিশেষ একটি কাজ সে চৌধুরীর সাথে করে থাকেন। প্রতিদিন রাত আটটায় অফিস শেষ করে চৌধুরীর কক্ষে প্রবেশ করে রাতের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত তাঁর পাশে শুয়ে থাকেন। যদিও এর বিনিময়ে বেতনের বাইরে তাঁকে খাওয়ার খরচ, পোশাক পরিচ্ছদ ও কসমেটিক, বিউটি পার্লার এর যাবতীয় খরচ ব্যক্তগতভাবে চৌধুরী বহন করে থাকেন। এর সবই প্রতক্ষদর্শী ছিলো রাকিব সাহেব। কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি। শুধু নিজের পরিবার ও সংসার জীবনের কথা ভেবে। রাকিব সাহেবের চোখের সামনে শত শতকর্মচারীদের চাকুরি থেকে অব্যহতি দিয়েছেন। রাকিব সাহেব এর আগে পিছে কখনোই ভাবার চেষ্টা করেননা। শুধু দিন রাত কাজ করে যান। আজ বিশেষ একটি দিন। পহেলা বৈশাখ। নুরীর ইচ্ছা এই দিনটিতে খুব আনন্দ উল্লাস করে পার করবেন। তাই চৌধুরীর কক্ষে প্রবেশ করে মাথা নত করে নিজেকে অপরাধীর ভান করে মৃদু হেসে সালাম দিয়ে বললো, স্লামুয়ালাইকুম স্যার।
চৌধুরী কফির কাপে চুমুক দিয়ে; ওয়ালাস্লাম!
: স্যার, একটা কথা বলতে চাইছিলাম।
: বলো!
: বলছিলাম কি, আজ পহেলা বৈশাখ, তাই আমরা অফিসটি সাজিয়ে ভালোমন্দ একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করতে চেয়েছিলাম।
চাকুরি শুরু থেকে এই পর্যন্ত নুরীর কোনো কথা চৌধুরী ফেলতে পারেনি, চৌধুরী খুব ভালো করেই জানে এর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করলে এই এলাকায় আমাকে জুতার মালা পরিয়ে ছাড়বে। পাশেই সিগারেটের এস্ট্রেতে সিগারেট অবিরাম পুড়েই চলছে। সিগারেটের ছাই এস্ট্রেতে ফেলতে ফেলতে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন: অফিসে কে কে আছে?
: স্যার, এখন শুধু ডেস্কে বসে সেলারী শীট তৈরি করছে রাকিব
স্যার।আর বাকিজনরা মার্কেটিংএ আছে, জিএম স্যার, ইডি স্যার, ঢাকা
গেছেন জরুরি একটা মিটিংয়ে।
: কখন আসবে?
: স্যার, যখনই আসুক, আমরা খাবারের আয়োজন করবো রাতে।
এখন আনুষাঙ্গিক কিছু কাজ আছে, আমরা সেগুলো আপাতত করতে
থাকি?
: করো, রাকিব সাহেব কোথায়? ডাকো।
: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
> রাকিব।
: নুরী, কি বলে?
স্যার, আমি এই ব্যপারে কিছু বলতে পারছিনা স্যার।
কেন, তোমার নাকি ধর্মের বোন?
: স্যার সম্পর্ক ভালো থাকলেই কি আর ধর্মের বোন হয়ে যায়?
: আমিতো সেটা জানি না! আসিফ (অফিস পিয়ন) সবসময় বলে, ম্যাডাম রাকিব স্যারের ছোট বোন।
যাকগে, দশজন অফিসার আজ রাতে সবাই এখানে খাবে, এই নাও দুই হাজার টাকা বাজার যা যা লাগে নিয়ে আস। চৌধুরী রাকিব সাহেবকে খুব বিশ্বাস করেন তাই সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড তাঁকে দিয়েই করিয়ে থাকেন। রাকিব সাহেব একঘন্টার মধ্যে সকল কেনাকাটা করে অফিসে ফিরলেন। নুরী অফিসের চার দেয়ালে লাল নীল কাগজ লাগিয়ে সমস্ত অফিস সাজিয়ে রাখলেন। রাতে সব কর্মকর্তা কর্মচারী একটি ঘরোয়া পরিবেশে আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে ভোজনের কাজ শেষ করে সবাই যাঁর যাঁর মত বাসায় চলে গেলো।
নুরী সবাইকে বিদায় দিয়ে আবার বাসায় যেয়ে আধা ঘন্টার মধ্যে ড্রেস পরিবর্তন করে আসলেন। এখন নুরী পরে এসেছে মেরুণ রঙের তাঁতের শাড়ী। নুরী শাড়ী পরতে খুব পছন্দ করেন। সাথে কপালে একটা বড় টিপও লাগিয়েছেন। দুই হাত ভর্তি কাঁচের চুরি আর পায়ের নুপুরের ছন্দতানে অফিসটি মুখরিত হয়ে উঠেছে। মেয়েরা স্বভাবতই যৌবন আসলে লাল রঙের শাড়ী আর টিপ ও কাঁচের চুরি পরতে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু। নুরী একটু ব্যতিক্রম স্বভাবের। সব মেয়েদের মত ওনা, সবার চেয়ে একটু ভিন্ন মতামত দেখায় সকল কাজে। বেশিরভাগ মেয়েরা ছেলেদের সিগারেট খাওয়া পছন্দ না করলেও নুরী ছেলেরা সিগারেট না খেলে পছন্দ করেন না। নুরীর এই ইচ্ছাটা রাকিব সাহেব সেদিনই বুঝতে পেরেছেন যেদিন নুরী রাকিব সাহেবকে ঢাকা বাণিজ্যমেলা থেকে একটা সিরামিক্সের এস্টে আর দামী একটা লাইটার উপহার দিয়েছিলেন সেদিনই রাকিব সাহেব বুঝতে পেরেছেন নুরী স্মোক করা খুব পছন্দ করেন। নুরীর ভেতরে ভেতরে একটা চাওয়া সবসময়ই কাজ করে সেটা হলো তাঁর হবো স্বামীটি যেন খুব রাগী হয় এবং অনেক ধনাঢ্যের পাশাপাশি কড়া একজন স্মোকার হয়। সিগারেট না খেলে নাকি ছেলেদেরকে মেয়ে মেয়ে লাগে। রাকিব সাহেব স্মোক করেন দিনে দুই থেকে তিন বার, সেটা অবশ্যই নুরীর খুব পছন্দ। রাকিব সাহেবের প্রতিমনে মনে নুরীর একটা ভালো লাগা কাজ করে। নুরী চান রাকিব সাহেব সবসময়ই তাঁর রূপ ও গুণের প্রসংশা করুক, তাঁকে নিয়ে প্রতিদিন একটা করে কবিতা রচনা করুক। রাকিব এসব বুঝেও না বুঝার ভান করে চলেন। আজ নুরী রাকিব সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করে বিনয় কন্ঠে আবদার করেই বসলো, স্যার! আপনার ডায়েরিতে আমি সব কবিতা পড়েছি। আপনার প্রতিটি কবিতার পঙ্ক্তিমালা আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছে, আমি সত্যি খুব গর্বিত। আপনাকে একটা অনুরোধ করবো রাখবেন কি?
: বলুন।
: আমার নামে একটা কবিতা লিখবেন, সেটা যেন অবশ্যই আমার পছন্দ হয়।
: আরে, যে কোম্পানির চাকুরি করি কবিতা লেখার সময় কই?
: আমি আপনার কিছু কাজ আগামীকাল করে দিবো, আজ একটা কবিতা লিখুন না, প্লিজ।
রাকিব সাহেব খুব ঝানু কবি, এককথায় বলতে গেলে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে বোকা বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাঁর গল্পের অন্দর মহলে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে জানেন। বাংলাদেশের কয়েকটি সংগঠন থেকে একাধিকবার তাঁকে সম্মাননা স্মারক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। এসব তথ্য সব জেনে নিয়েছে নুরী। গোপনে তাঁর সাবেক প্রেমিকা সোহাগীর সাথে কথা বলে একটা শক্তিশালী বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। রাকিব এসব কিছুই জানে না। হরহর করে রাকিব সাহেবের সব গোপন তথ্য নুরী বলে রাকিবকে বিস্মিত করে তুলছে। আজ রাকিব বুঝতে পেরেছেন মাঝেমধ্যে যে নিজের অফিস রুমের চাবি নুরীর কাছে দিয়ে যান এটাই তাঁর মূল রহস্য। হঠাৎ রাকিব সাহেব মৃদু হেসে বললেন, আচ্ছা! :
স্যার, হাসলেন যে?
: না ভাবছি, কবিতাটি কিভাবে শুরু করবো।
: কথা কাটাবেন না, প্লিজ।
: আরে নাহ। তেমন কিছু না, হঠাৎ এমন সময় চৌধুরীর কলিং বেল
বেজে উঠলো।
: আসসালামু আলাইকুম স্যার।
: ওয়ালাইকুম আস ছালাম। পং এ্যাপারেলস এর মামলাটি কতদূর কি করলা?
: স্যার, আমিতো থানার ওসির সাথে মামলাটি নিয়ে কমিকেশন করছি, তিনি যে সমস্ত কথা বলছেন: আসলে জানিনা সামনে কি হবে! তবে আমার মনে হয় হাই কোর্টের একজন দক্ষ উকিলের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসা দরকার!
: বস, কাকে বলো? আমি বসবো?
: না, ব্যাপারটা সেরকম না। আমি বলতে চাচ্ছি: বুঝেনইতো বাংলাদেশের উকিলরা টাকা ছাড়া কোন কথা বলেনা। সেখানে আলোচনা করতে গেলে টাকার প্রয়োজন, এবং আপনার অনুমোদন না পেলে কিভাবে আগাই!
: তোমার জানামতে কোনো ভালো উকিল আছে কি?
: ঢাকা পল্টনে একজন পরিচিত উকিল আছে তাঁর সাথে কথা বলে দেখতে হবে।
: নাম কি।
: এ্যডভোকেট শমশের আলী। খুব তুখোড় এ্যডভোকেট। তিনি যে সমস্ত মামলা নিয়ে কোর্টে লড়েন সেই সব জটিল মামলা। তিনি ফাঁসির দাগী আসামীকেও জামিন করাতে পারেন।
: কোথায় কাজ করেন?
: ঢাকা, হাই কোর্টে।
• আগামীকাল তাহলে তাঁর সাথে আলোচনা করে দেখ,
: ওকে স্যার।
রাকিব সাহেব চৌধুরীর রুম থেকে বেড়িয়ে এসে ড্রয়ার থেকে ভিজিটিং কার্ড খুঁজে বের করে ফোন দিয়ে সব বিস্তারিত খুলে বললেন। উকিল চুক্তিনামার বিবরণ জেনে সাহস দিয়ে বললেন: রাকিব সাহেব কোনো চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টি দেখছি। কিছু করতে পারবেনা যেহেতু অত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে আরও দুই মাস আগে ডিড শেষ হয়ে গেছে, উল্টো আরও তাঁদের নামে মামলা হবে।
উকিলের কথা শুনে রাকিব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: স্যার আমি খুব প্রেসারে আছি, বিষয়টি আপনি দেখলে আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।
: ওকে।
: ধন্যবাদ স্যার।
রাকিব সাহেব নিজেকে একটু হালকা মনে করলো। সিগারেটের মাথায় আগুন ধরিয়ে নুরীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভাবতে ভাবতে কয়েক লাইন কবিতা লিখে ফেললেন।
– একটা বিষাক্ত ধরণীর পরে আমি আবদ্ধ করে রেখেছি নিজেকে!
নুরী। বলতে পারো কিসের বাসনায়? কিই বা অভিপ্রায়ে? কিইবা প্রলোভনে? নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করি বারবার! হয়তো কোনোদিন নিজের মত করে, ফিরে পাবো না তাঁকে! যে আমাকে বারবার কাঁদিয়েছে। আমি কি ভালোবাসার মাকড়শার বেড়াজালে আটকে গেছি? নাকি একটা চাকুরির মায়ায়? একটা চাকুরি হয়তো দুদণ্ড আমাকে সুখ দিবে! কিন্তু! সস্থি দিবে কে? যে দিবে সেতো ভুল মানুষের ঘরে নজর বন্দী। আমি তাঁর সবই জানি, তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই ঢাকার অলিতে গলিতে খুঁজে খুঁজে নীরহারা বিহঙ্গের মত বাসায় ফিরে আসি। এই মনটা যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাঁর মুখ না দেখে ঘরমুখী হবে না! হায়রে ছলনাময়ী হৃদয়হীনা স্বার্থপর নিষ্ঠুর নারী। তুমি জানতেই চাইলে না। আমি কি একটা মিথ্যে প্রেমের উত্তপ্ত দহনে নীরবে জ্বলছি।
ছাই করে দিচ্ছি নিজেকে অঙ্গার থেকে।
নাহ। আর নয় ভালোবাসা। আর নয় প্রেম।
আর নয় মিথ্যে অনুশোচনা।
আর নয় ভালোবাসার নামে লুকোচুরি প্রেম প্রেম খেলা।
যেখানে প্রেম নেই।
যেখানে ভালোবাসা নেই! যেখানে সুখ নেই! যেখানে শান্তি নেই! যেখানে নেই স্বর্গীয় সুখের চিহ্ন লেশ মাত্র! সেখানে আমি আর এক মুহূর্তও থাকবো না! আমি আবার প্রত্যাবর্তণ করবো সেই দেশে। যেখানে মিলবে আমার সুখ, শান্তি, অফুরন্ত ভালোবাসা! স্পর্শহীন প্রেম, একে অপরের প্রতি নির্ভুল বিশ্বাস!