যে জলে দু’জন জ্বলে!
——— মনিরুজ্জামান বাদল।
শরতের মাঝামাঝি সময়ে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া।বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার আগমুহূর্তে বৈরিতার হাওয়া আচমকা গায়ে এসে লাগলো। বাড়ির গেটে চোখ পরতেই দেখা গেল দুধের বাচ্চা কোলে নিয়ে অপরুপ সুন্দরী মহিলার আগমন। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন হিমেল। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী মুনার কথা ভাবছে আনমনে। মুনা আজ এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। স্বামীর ঘর-সংসার রেখে খুব কম সময়ই থাকেন। কাকতালীয়ভাবে এবার হয়তো জরুরি কোন কাজে আটকে আছে। দশ বছর পর আজ হঠাৎ করে প্রাক্তন প্রেমিকা শিলার সাথে দেখা হিমেলের। হিমেলের গ্রামেই শিলার নানার বাড়ি। শিলার বিয়ের পর খুব বেশি একটা আসা হয়না। হিমেলের পাশের বাড়ি এসেছিল মেয়ের জন্য দুধ কিনতে,কিন্তু ভাবতেই গা ছমছম করে উঠছে বিচ্ছেদের দশ বছর পর আজ নিজের বাড়ির উঠোনে শিলাকে দেখে ভূত দেখার মত আচমকা চমকে উঠলেন হিমেল। বয়সের সাথে সাথে শিলা যে এত সুন্দরী হয়েছে হিমেল কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি। কারন তার আর শিলার শহর পুরো আলাদা। হিমেল বিচ্ছেদের পরই নামীদামী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি নিয়ে বৌ বাচ্চা নিয়ে শহরেই স্যাটেল না হলেও বাবা মাকে দেখার নেশায় স্ত্রীকে আপতত গ্রামেই রেখেছেন। মুনা গ্রামে থাকলেও শহরের পরিবেশের মতই খুব পরিপাটি পরিবেশ নিয়ে থাকেন। কিন্তু শিলাকে শহরের ইট-পাথরের বাড়িতে থাকার উন্মাদনায় মুখর করে রাখলেও নিয়তির নির্মম পরিহাসে দরিদ্র কৃষক ছেলের সাথে বিবাহ হওয়ায় শহরে আর থাকা হয়নি। তবুও নিজেকে অপার সৌন্দর্যে মোহনীয় করে রাখতে মুখিয়ে থাকে। নচেৎ গ্রামের চরাঞ্চলের ক্ষেত খামারে কাজ করেও শিলা এত রুপবতি কিভাবে থাকে! এসব নানা অবান্তর প্রশ্নে জর্জরিত হতে থাকে হিমেল। শিলা মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, হিমেল কেমন আছো?
হিমেল শুনল না, আবার প্রশ্ন, হিমেল কেমন আছ?
এবার হিমেল সম্বিত ফিরে পেয়ে ছলছল চোখে ভেজাগলায় জবাব দিল, এইতো আলহামদুলিল্লাহ! তুমি?
– আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার বৌ কোথায়?
– বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।
– তুমি যাওনি?
– না!
– কেন?
– সবসময়ই শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে এমন কোন কথা!
দুজনের কথার ফাঁকে হঠাৎ হিমেলের মা শাহেলা বেগম শিলাকে দেখে আনন্দে বিমোহিত হয়ে জিজ্ঞেস করে শিলা কবে আসছো?
– আসছি গতকাল! ওই বাড়ি মামাদের ওখানে দুধ কিনতে আসছি।
– বাইরে দাঁড়িয়ে কিসের কথা, ঘরে আস।
মুনার অনুপস্থিতির কারণে নির্দ্বিধায় হিমেলের খাটে গিয়ে বসলো শিলা! শিলা কথার ফাঁকে ফাঁকে ঘরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে দেখছে। ওপরে একচিলতে হাসির ঝিলিক থাকলেও ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। সু-কেসে রাখা হিমেলের মোটা ফ্রেমের চশমাটি পরা ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া কোঁকড়া চুল সহ ছবি দেখে বিষ্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে এই ছবিটি কার!
– ভালো করে তাকিয়ে দেখ, চিনতে পারো কিনা?
এবার আর চিনতে কষ্ট হলো না।তীব্র হাহাকারে নিমিষেই একটা কালবৈশাখি ঝড়ের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেল শিলার হৃদয়। দুফোঁটা অশ্রু কখন জানি মনের বেখেয়ালে গাল বেয়ে গড়িয়ে বুকের উর্নাটা ভিজে গেছে। ঘরের শূণ্যতায় দুজনেই বেহায়া নির্লজ্জ হয়ে শিলার খুব কাছাকাছি হিমেল। জীবনের পরিপূর্ণতা বুঝি আজই প্রথম পেল। হিমেল টেরই পাইনি কখন নিজের হাতের স্পর্শে শিলার অশ্রু মুছে দিয়েছে। মনে হয় হাজার বছর পর সাগরের দুই মেরু থেকে অন্তিম ঠিকানায় ভেসে বেড়ানো কচুরিপানার মিলনের মোহনায় স্থির হয়েছে।
তাকে ফের নিজের বাড়িতে দেখতে পেয়ে বেশ অবাক হলো। শিলার দিকে চেয়ে দেখলো শিলাও তার দিকে অপলক চোখে চেয়ে আছে। শিলার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরটা দেরিতে আসে। হিমেল আরও এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসার পুনরাবৃত্তি করলো-
-কেমন আছো শিলা ?
শিলার নয়ন জোড়া ছলছল করে উঠলো। আশেপাশে তাকিয়ে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ার আগেই সন্তপর্ণে জল টুকু মুছে নিয়ে মুখে হাসি এনে বলল-
এই তো যেমন টা রেখে গিয়েছিলে তেমন টাই আছি।
-আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না?
শিলা মুচকি হেসে বলে-
-সেটা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করছি না। কারন ভালো থাকার জন্যই তো আমাকে ছেড়েছিলে। বউ নিয়ে নিশ্চয়ই সুখীই আছো। তা হঠাৎ এই সময়ে বাড়িতে যে?
-আমি ছুটিতে আসছি!
শিলা অবাক হলো।
-তোমার বউ কোথায় থাকে ?
-বউ বাড়িতেই থাকে ।
– কেন! বাসায় নিয়ে যাওনা কেন?
– সন্তানের পড়াশোনাটা আমি আমার নিজ জেলায় করাতে চাই। তাছাড়া বাবা-মাকেও প্রতিমাসে দেখা হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো একসময় শহরে বৌ নিয়ে ছিলাম, বনিবনা হচ্ছিল না। ঝগড়াঝাটি নিত্য দিন লেগেই থাকে। আক্ষেপের গলায় কথাগুলো বললেন হিমেল।
– কি নিয়ে ঝগড়া হয়? হিমেলের কথায় যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে শিলা।
– সে অনেক কথা, ওগুলো বাদ দাও!
– শিলা চাপা হেসে বললো, আমাকে বিয়ে করলেও তো দূরে রাখতে?
– অসম্ভব!
– কেন?
– ও আমাকে বুঝতে পারে না। তুমি কখনো এমনটা করতে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
– এতো বিশ্বাস কিভাবে হলো আমার ওপর!
– শুরু থেকেই আমি তোমাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছি।
– মুনা কি দেখতে আমার চেয়ে কম সুন্দরী?
– সুন্দর দিয়ে কখনো সংসার হয় না।
– তাহলে কিসে?
– সংসার হয় সেক্রিফাইজ,অপরিসীম শ্রদ্ধা,আর বিশ্বাসের শক্ত বাঁধনে আটকে থাকলে।
– আমিও সুখে নেই!
– যেমন?
– ও পুরোপুরি অশিক্ষিত। একটা বদমেজাজি মুর্খের সাথে সংসার করা মানে জীবনের সাথে যুদ্ধ করা সমান কথা। পঁচা শামুকে পা কেটে গেছে মাঝেমধ্যে এমনটা মনে হয়।
– জীবনের পরিপূর্ণতা পেতে গেলে একজন ভালো মানুষের কতটা প্রয়োজন এখন বুঝো!
– আমি আগে থেকেই বুঝতাম কিন্তু মা আমার মনটাকে ভেঙ্গে দিয়ে এক হত দরিদ্র কৃষকের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন। যাঁর কাছে প্রেম ভালোবাসা,জীবন সংসার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সবই তুচ্ছ! শুধু তিন বেলা খাবার আর কাজ ছাড়া কিছুই বুঝে না। ও আমার জীবনের সকল রঙ মুছে দিয়ে ধূসর করে দিয়েছে। গভীর প্রেম মানুষকে শুধু কাছেই টানে না, অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়!
– একটা দিনও কি আমাকে মনে পড়েনি?
– অসংখ্যবার মনে পড়েছে। যতবার তোমাকে ভেবেছি ততবারই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরিয়েছি। কিন্তু কি করবো সমাজ,সংসার আর ভাগ্যের বেইনেটে আমার সকল ইচ্ছে আকাঙ্খা ছাইচাপা দিয়েছি। একটা সময় স্বামী সংসারের জন্য অথৈ সাগরের মাঝির মত কূলে ভীড়ার আশায় এলোপাতাড়ি বৈঠা চালিয়েছি। অবশেষে এখন নিয়তির কাছে হার মেনেছি। ভাগ্যের কাছে গরীবের প্রেম, চাওয়া পাওয়া রঙ তামাশা অসহায়। ও যখন আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে তখন তোমাকে অনেকবার মিস করেছি। কথাগুলো বলতে বলতে হিমেলের বুকে মাথা গুঁজে দুফোঁটা অশ্রু ফেললেন। না পাওয়ার বেদনায় হিমেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে শিলার গালে পাগলের মত চুমো খেতে লাগলো। অনেকটা সূর্যের আলোয় চাঁদের আলোকিত হবার মতো শিলাও হিমেলের মত অস্থির হয়ে উঠলো।
প্রেম থেকে বিচ্ছেদ পর্যন্ত কখনো কোনদিন কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি। বিষ্ময়ের অতল গহীনে তলিয়ে যায় হিমেল আর শিলা। আজ বিচ্ছেদের দশ বছর পর দু’জন দু’জনকে ছুঁয়ে দেখেছে। একজন আরেকজনের স্পর্শ পেয়ে যেন পৃথিবীটাকে ভুলে গিয়ে স্বর্গীয় আনন্দে সাঁতার কাটছে শিলা ও হিমেল।
হঠাৎ হিমেলের মা ঘরে প্রবেশ করল।
শিলা আজ আর কোথাও যেতে পারবে না। মুনাও বাড়িতে নেই।
– না মামী! সম্ভব না। আমাকে আম্মা খুঁজবে।
– খুঁজলে কি হবে! এটা কি অন্য মানুষের বাড়ি? ছাত্রজীবনে সবাই সম্পর্ক করে। কারওটা বিয়েতে গড়ায় কারও বিয়ে হয়না। আমি তোমাদের সম্পর্কের কথা শোনা মাত্রই রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু তোমার মা রাজি হলোনা।
– মা শুধু মামাকে ভয় পেয়েছিলো।
– তোমার মামাই তো বেশি রাজিখুশি ছিলো। পরে আমাদের চারপাশে তোমাদের নিয়ে চাপা গুঞ্জন ছড়ছিল তখন সে আমরা তাড়াহুড়ো করে হিমেলকে বিয়ে করালাম।
– আসলে কপালে নেই মামী! হিমেল ভাইয়ার যদি একটা চাকুরি থাকতো ওই সময় তাহলে আর কোন সমস্যা ছিল না।
– চাকুরী কি মায়ের পেট থেকে কেউ নিয়ে আসে, পড়াশোনা শেষ না করতেই আগেই চাকুরি কিভাবে করবে? মাস্টার্স শেষ করে এখন কি চাকুরি করছে না?
– মামী আসলে ঘটনাটি এমন হবে আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো হিমেল ভাইয়া এত কম বয়সে বিয়ে করবে কে জানতো? বিয়েটা কিন্তু আপনার ছেলেই আগে করেছে।
– তোমার মায়ের মতামত না পাওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা যাকগে, তোমরা কিছুক্ষণ গল্প কর আমি আসছি।
– হিমেল নামক মানুষ টাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে-
-আমি ভালো নেই হিমেল । সংসারে প্রতিনিয়ত আনোয়ারের সাথে ঝগড়া ঝাটি করতে করতে আমি হাঁপিয়ে গিয়েছি। তুমি একটু সাহস করে সেদিন আমার হাত টা ধরলে আজ আমি তোমার সাথে থাকতাম। আমাদের ছোট্ট সংসার হতো। আচ্ছা হিমেল বলতে পারো কেনো এক সাথে থাকা যায় না চিরকাল? কেনো মায়া বাড়িয়ে চলে গেলে? তোমার সাথে আবার দেখা হয়ে তোমার প্রতি জমে রাখা অভিমান আরো দীর্ঘ হলো হিমেল। আমার জীবনটা তুমি তছনছ করে দিয়েছ। তুমি আমাকে জাহান্নামের আগুনে ফেলে দিয়ে গেছো। প্রতিদিন জায়নামাজে তোমার জন্য অশ্রু ফেলেছি আমাকে ঠকানোর শাস্তি যেনো তুমি পাও। দেখো তাই হলো আমিও পুড়ছি সেই সাথে তুমিও পুড়ছো অজান্তে। তুমিও সুখী নও আমি ও সুখী নই।
শিলার কথাগুলো তীরের মতো বিদ্ধ হলো হিমলের ইন্দ্রিয়তে! অবচেতন অবস্থায় অবসাদ আর গাঢ় বিষন্নতায় দু’জন হয়ে গেছে লাবণ্যহীন পাথরের মতো, শিলা চোখের পানি গুলো তাড়াতাড়ি মুছে নিলো। না পাওয়ার অমোঘ একটা মিহিন কষ্ট বদলে দিয়েছিল সমস্ত দৃশ্যপট, বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। না জানি ঘরে ফিরলে মায়ের আবার কোন কথা শুনতে হয়। মহিলা টা পান থেকে চুন খসলেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে। শিলা ঘরের ভেতর থেকে একবার বাড়ির উঠোনের দিকে তাকালো। অনেকেই বাড়ির আঙ্গিনায় আনাগোনা করছে। কেউ কেউ মুনাকে ভেবে তাকাচ্ছে না। বরফগলা নদীর মত হিমেল বরফে পরিণত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। বিশালত্বের মহিমায় আজ দু’জন দু’জনার থেকে অনেকটাই দূরে। হাত পা যেন ক্রমশই অবশ হয়ে আসছে। শিলাকে বিদায় জানানোর ভাষাটুকো হারিয়ে ফেলেছে। শিলাকেও দেখে মনে হচ্ছে ঝড়ের তান্ডব থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আসছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। গালে অসংখ্য কামড়ের দাগ।
শাড়ীর ভাঁজগুলো————- । এযেন গোধূলির লগ্নে একচিলতে সোনালি রোদের ঝলকানি। কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। তবুও যে যেতে হবে দূর থেকে বহুদূর———————!
রচনাকাল – ছাব্বিশ, বারো,বিশ-তেইশ।